নবজাতকের জন্ডিস ও প্রতিকার
অধ্যাপক ডা. মোঃ আশরাফুল ইসলাম
শিশুর জন্মের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জন্ডিস দেখা দিতে পারে। নবজাতকের জন্ডিসেরও রয়েছে নানা ধরন। কখনো তা হতে পারে খুবই সাধারণ জন্ডিস, যা আপনাআপনি সেরেও যায়। আবার কিছু জন্ডিস আছে এমন—যা হতে পারে মস্তিষ্ক জটিলতার মতো মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ। এমনকি জন্ডিসে মৃত্যুও হতে পারে নবজাতকের।
জন্ডিস কী
জন্মের পর শিশুর যকৃৎ পুরোপুরি কর্মক্ষম হয়ে উঠতে একটু দেরি হলে রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে গিয়ে জন্ডিস দেখা দেয়। সাধারণত নবজাতকের শরীরে লোহিত রক্তকণিকা বেশি থাকে, আর কোনো কারণে তা ভাঙতে শুরু করলে, বিলিরুবিন বেড়ে যায়। বিলিরুবিন হলো হলুদ রঙের একটি রঞ্জক পদার্থ। রক্তে এই পদার্থটির পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি হলে চোখ, হাতের তালু ও সমস্ত শরীর হলুদ রং ধারণ করে। এই পরিস্থিতিকে জন্ডিস বলা হয়।
লক্ষণ ও উপসর্গ
- নবজাতকের চোখের সাদা অংশ ও ত্বকের রং হলুদ বর্ণ ধারণ করে।
- হলদে ভাব শুরুতে মুখমণ্ডলে দেখা যায়। তারপর আস্তে আস্তে সমস্ত শরীর হলুদ হয়। সঙ্গে সঙ্গে হাত ও পায়ের তালুও হলুদ হয়ে যায়।
- পেট ফাপা, ঝিমুনি ও বমি বমি ভাব।
- তীব্র জ্বর।
- খেতে না পারা এবং নড়াচড়া কমে যাওয়া।
- শরীর বেশি ঠান্ডা হওয়া।
- কখনো খিঁচুনিও হতে পারে।
নবজাতকের জন্ডিসের ধরন
ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিস
শতকরা ৭০ থেকে ৮০ ভাগ নবজাতকেরই জন্মের পরপর জন্ডিস হতে পারে। এর মধ্যে ৫০ শতাংশের ক্ষেত্রে ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিস দেখা যায়। এটি খুবই সাধারণ জন্ডিস। জন্মের দুই থেকে তিন দিনের মাথায় যে জন্ডিস দেখা দেয় এবং সাত-আট দিনেই ভালো হয়ে যায় তাকে ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিস বা স্বাভাবিক বলেই ধরে নেওয়া হয়। এতে শিশুর তেমন একটা ক্ষতি হয় না। এমনকি এই জন্ডিস আপনাআপনি সেরেও যায়।
প্যাথোলজিক্যাল বা ক্লিনিক্যাল জন্ডিস
এই ধরনের জন্ডিস জন্মের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই দেখা দেয়। প্যাথোলজিক্যাল বা ক্লিনিক্যাল জন্ডিস সাধারণত জটিল হয়ে থাকে। এতে শিশুর শরীরে নানা ধরনের অস্বাভাবিক পরিবর্তনও দেখা দেয়। এই জন্ডিসেরও রয়েছে নানা ধরন।যেমন—
হেমোলাইটিক অ্যানিমিয়া : এ ক্ষেত্রে নবজাতকের শরীরে রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। সেই সঙ্গে লিভার ও প্লীহা বড় হয়ে যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে রক্তের বিলিরুবিন দ্রুত বাড়তে থাকে। যথাসময়ে সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ না করলে নবজাতকের মৃত্যু হতে পারে।
প্রি-ম্যাচিউরড শিশু : এই নবজাতকের জন্ডিসের মাত্রা বেশি ও দীর্ঘমেয়াদি হয়।
রক্তের গ্রুপজনিত জন্ডিস : নবজাতকের রক্তের গ্রুপ আর এইচ পজিটিভ এবং মায়ের রক্তের গ্রুপ আর এইচ নেগেটিভ হলে সদ্যোজাত শিশুর জন্ডিস হতে পারে।
ইনফেকশন : নবজাতকের রক্তে ইনফেকশন ছড়িয়ে গেলে একে সেপটিসেমিয়া বলে। এই পরিস্থিতিতে শিশুকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে সঠিক অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করতে হয়।
মায়ের ডায়াবেটিস : কোনো নবজাতকের মায়ের ডায়াবেটিস থাকলে নবজাতকের জন্ডিস হতে পারে। এ ক্ষেত্রে নবজাতকের শর্করা লেভেল স্বাভাবিক রাখতে ঘন ঘন বুকের দুধ খাওয়াতে হবে।
যেসব নবজাতক ঝুঁকিতে
- যাদের জন্মের সময় ওজন কম থাকে।
- সময়ের আগেই জন্ম নেওয়া শিশু (প্রিম্যাচিউর বেবি)।
- আগেও যদি একই পরিবারের শিশুর জন্ডিসের ইতিহাস থাকে।
- জন্ডিস যদি প্রথম ২৪ ঘণ্টায়ই দেখা যায়।
- যেসব মায়ের অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থাকে।
- বুকের দুধ পান করা শিশু।
- মায়ের রক্তের গ্রুপ যদি নেগেটিভ বা ও গ্রুপের হয়।
রোগনির্ণয়
রক্তের বিলিরুবিন পরীক্ষার মাধ্যমে জন্ডিস নির্ণয় করা যায়। বাচ্চা ও মায়ের রক্তের গ্রুপ, কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট, রেটিকুলোসাইট কাউন্ট, ডাইরেক্ট কমব্স টেস্ট ও টর্চ স্ক্রিনিংসহ নানা পরীক্ষা করা হয় জন্ডিসের কারণ নির্ণয় করার জন্য।
চিকিৎসা
নবজাতকের রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা কেমন, শিশু কত সপ্তাহে জন্মগ্রহণ করেছে, বিলিরুবিন কী পরিমাণে বাড়ছে, তার ওপর চিকিৎসাব্যবস্থা নির্ভর করে। জন্ডিসের মাত্রা বেশি মনে হলে হাসপাতালে এনে ফটোথেরাপি দিতে হয়। ফটোথেরাপি খুব কার্যকর একটি চিকিৎসাপদ্ধতি। নীল আলোর ফটোথেরাপি, বিলি ব্লাকেট ও লেড ফটোথেরাপি জন্ডিসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। তবে জন্ডিসের ধরন ও বিলিরুবিনের মাত্রা নির্দিষ্ট সীমার বাইরে গেলে রক্ত বদল করার প্রয়োজনও হতে পারে। এ ক্ষেত্রে নাভির শিরাপথে বাচ্চার শরীরের রক্তের দ্বিগুণ পরিমাণ রক্ত দিয়ে এই চিকিৎসা করা হয়। মনে রাখা দরকার রক্তে বিলিরুবিন খুব বেশি বেড়ে গেলে তা মস্তিষ্কে পৌঁছে যায় এবং স্থায়ীভাবে শিশুর মস্তিষ্কের ক্ষতি করতে পারে।
অধ্যাপক ডা. মোঃ আশরাফুল ইসলাম
এমবিবিএস, এফসিপিএস (মেডিসিন), এমডি (গ্যাস্ট্রো)
মেডিসিন, পরিপাকতন্ত্র ও লিভার রোগ বিশেষজ্ঞ
অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজি বিভাগ (প্রাক্তন)
ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল
চেম্বার : ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল, ধানমন্ডি