নারীদের মধ্যে বাড়ছে হৃদ্রোগের ঝুঁকি
ডা. অরুন কুমার শর্মা
মিতু বেগমের বয়স ৫৩ বছর। তিনি উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের রোগী। প্রাকৃতিক নিয়মেই বছর দুই হলো তাঁর মাসিক বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আজকাল মেজাজটা কেমন যেন খিটখিটে হয়ে থাকে তাঁর। মানসিক অবসাদে ভোগেন। অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়ার জন্য ওজনটাও যেন দিন দিন বেড়েই চলেছে। একদিন হঠাৎ তিনি বুকে ও ঘাড়ে তীব্র ব্যথা অনুভব করলে সাথে সাথে তাঁকে চিকিৎসকের কাছে নেওয়া হয়। চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানান তিনি হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়েছেন।
নারীদের মধ্যে হৃদ্রোগের ধরন
বিশ্বব্যাপী নারী-পুরুষভেদে হৃদ্রোগে মৃত্যুর হার বেড়েই চলেছে। আগে মনে করা হতো হৃদ্রোগ শুধু পুরুষদেরই হয়। কিন্তু এই ধারণা ভুল। বর্তমানে নারীরাও ব্যাপক হারে এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, ঋতুমতী নারীদের তুলনায় যেসব নারীর ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে গেছে, তাঁদের হৃদ্রোগে আক্রান্ত হওয়ার হার ও ঝুঁকি দুটোই বেশি। ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন নামক হরমোন ধমনির রক্তনালিতে চর্বি জমতে বাধা দেয়। মাসিক বন্ধ হয়ে গেলে এই হরমোন কমে যায়। ফলে মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়া নারীদের হৃৎপিণ্ডের রক্তনালির রোগে (ক্যাড) আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। বয়সভেদে নারীদের হৃদ্রোগের লক্ষণের মধ্যেও রয়েছে ভিন্নতা। কারো গ্যাস্ট্রিকের মতো ওপর পেটে ব্যথা, বমি বমি ভাব, ঘাড়ব্যথা হতে পারে। আবার, কারো হতে পারে বুক ধড়ফড়, বুকে ব্যথা ও অস্বস্তিকর অনুভূতি।
ঝুঁকির হার
বাংলাদেশে বছরে যত মৃত্যু হয়, তার ৩৪ শতাংশের জন্য দায়ী হৃদ্রোগ। সংখ্যায় তা ২ লাখ ৭০ হাজারের বেশি। গবেষণা অনুযায়ী, ঋতুমতী নারীদের ধমনিতে ১টি ব্লক এবং মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়া নারীদের ধমনিতে ৩টি ব্লক হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। ঋতুমতী নারীদের ক্ষেত্রে একটি ব্লকের হার ৩১ শতাংশ, দুটি ব্লকের হার ১৭ শতাংশ, ৩টি ব্লকের হার ২০ শতাংশ। অন্যদিকে মাসিক বন্ধ থাকা নারীদের মধ্যে এই হার যথাক্রমে ১৬ শতাংশ, ১৯ শতাংশ ও ৪৯ শতাংশ প্রায়।
কেন বাড়ছে নারীদের মধ্যে হৃদ্রোগের ঝুঁকি
বিভিন্ন কারণেই একজন নারীর হৃদ্রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এর মধ্যে রয়েছে—
ডায়াবেটিস : হৃদ্রোগের অন্যতম কারণ ডায়াবেটিস। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নারীদের এই রোগের ঝুঁকি বেশি থাকে।
উচ্চ রক্তচাপ : যেসব নারীর উচ্চ রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল রয়েছে, তাঁরা হৃদ্রোগে বেশি আক্রান্ত হন।
বয়স : যেকোনো বয়সের নারী হৃদ্রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। তবে, অপেক্ষাকৃত বেশি বয়সী নারীদের মধ্যে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
রোগ ধরতে দেরি হওয়া : নারীদের ক্ষেত্রে অনেক সময় হৃদ্রোগে আক্রান্ত হলে বুকে ব্যথা না হয়ে ক্লান্তি, শ্বাসকষ্টের মতো লক্ষণ দেখা যায়। এ জন্য তাঁরা বুঝতে পারেন না যে, তাঁদের হার্টের সমস্যা হয়েছে। ফলে, সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসার অভাব তাঁদের এই রোগকে আরও গুরুতর করে তোলে।
মানসিক চাপ : কর্মব্যস্ততার ফলে অনেক নারী ক্লান্তি ও অবসাদে ভোগেন। এতে মনের ওপর চাপ পড়ে। আর এই মানসিক চাপ তাঁদের হৃদ্রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে।
ধূমপান : যেসব নারী ধূমপান এবং মদ্যপান করেন তাঁরা অন্যদের তুলনায় বেশি ঝুঁকিতে থাকেন।
নারীদের ধমনির গঠন : পুরুষদের তুলনায় নারীদের ধমনি ছোট হয়ে থাকে। ফলে তাঁদের করোনারি ধমনির রোগ আরও বেশি হারে প্রকাশ পায়।
ঝুঁকি রোধে করণীয়
একটু সচেতনভাবে জীবনযাপন করলে হৃদ্রোগের ঝুঁকি অনেকটা কমিয়ে আনা যায়। এর জন্য প্রয়োজন—
- স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন।
- নিয়মিত সুষম খাদ্য গ্রহণ।
- প্রতিদিন ব্যায়াম করা ও ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা।
- ধূমপান ও মদ্যপান ত্যাগ করা।
- মানসিক চাপমুক্ত থাকা।
- পরিমিত ঘুমানো।
- রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা।
- চর্বিযুক্ত খাবার কম খাওয়া।
- নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা।
হৃৎপিণ্ডের যেকোনো জটিলতা দেখা দিলে সময়ক্ষেপণ করবেন না। দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন এবং পরামর্শ মেনে চলুন।
ডা. অরুন কুমার শর্মা
এমবিবিএস, এমসিপিএস (মেডিসিন), এমডি (কার্ডিওলজি),
এফএসিসি (ইউএসএ)
ক্লিনিক্যাল অ্যান্ড ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট
সিনিয়র কনসালট্যান্ট অ্যান্ড ইনচার্জ (সিসিইউ-২)
ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল