ফ্যাটি লিভার: লিভারে চর্বি রোগ
ডাঃ বিমল চন্দ্র শীল
ফ্যাটি লিভার কী?
সাম্প্রতিককালে ফ্যাটি লিভার নামক একটি রোগের প্রাদুর্ভাব প্রায়ই লক্ষণীয়। লিভার বা যকৃতের কোষসমূহে অতিরিক্ত চর্বি জমার কারণেই উক্ত রোগ দেখা দেয়।

কত প্রকার?
১। অ্যালকোহলিক (মদ্যপানজনিত) ফ্যাটি লিভার রোগ (AFLD) ২। নন অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার রোগ (NAFLD)
(মদ্যপানজনিত নয় এমন কারণে ফ্যাটি লিভার রোগ) যেহেতু এই রোগটিই আমাদের দেশে বেশি দেখা যায়। এই প্রবন্ধে নন অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার রোগটি আলোকপাত করা হলো।
লিভারে চর্বি জমার কারণ সমূহ কি?
- শরীরের অতিরিক্ত ওজন (Obesity)
- রক্তে চর্বির আধিক্য (Dysilipidemia)
- ডায়াবেটিস
- ইনসুলিন কার্যকরহীনতা (Insulin Resistance)
কায়িক পরিশ্রম বা ব্যায়ামবিহীন আরামপ্রদ জীবনযাপন (Sedentary Life Styles) এবং অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস উপরোক্ত অবস্থাসমূহের প্রধান কারণ।
লিভারে চর্বির অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কারণসমূহ
- মদ্যপান
- হেপাটাইটিস সি
- উইল্সন ডিজিজ (ডরষংড়হ’ং ফরংবধংব)
- অনেক দিন ধরে উপবাস
- হরমোনজনিত রোগÑ হাইপোথাইরপয়েডিজম, হাইপোপিটুইটারিজম।
- কিছু ওষুধ যেমন—এমিয়োডেরন, স্টেরয়েড, মেথোট্রেক্সেট, টেমোক্সিফেন, ভেলপ্রোয়েট ইত্যাদি।
এ রোগটির ব্যাপ্তি কেমন?
বিভিন্ন গবেষণাপত্রে রোগটির ব্যাপকতা দেখানো হয়েছে।
একটি পরিসংখ্যান উল্লেখ করা হলো—
স্থূল দেহ (বি.এম.আই > ৩০)- ৯৪% লোক রোগাক্রান্ত।
অতিরিক্ত ওজন (বি.এম.আই > ২৫)- ৬৭% লোক রোগাক্রান্ত।
স্বাভাবিক ওজন- ২৫% লোক রোগাক্রান্ত
ডায়াবেটিক রোগী- ৪০-৭০% লোক রোগাক্রান্ত।
(বি.এম.আই) = শরীরের ওজন (কেজি)
উচ্চতা (মিটার)২
আমাদের দেশে সাধারণ হিসেবে শতকরা ১৮ থেকে ২০ ভাগমানুষ উক্তরোগে ভুগছেন।
রোগটি কীভাবে অগ্রসর হয়?
লিভারে চর্বি (Steatosis) > কোষসমূহে চর্বিজনিত প্রদাহ (Steatoepatitis) > ক্রমবর্ধমান লিভারে ফাইব্রোসিস
> লিভার সিরোসিস > লিভার ক্যান্সার
ফ্যাটি লিভার রোগের জটিলতা কি হতে পারে?
১। লিভার সিরোসিস, ২। লিভার ক্যান্সার, ৩। হৃদরোগজনিত ঝুঁকি বৃদ্ধি।
রোগটির লক্ষণগুলো কী কী?
- বেশির ভাগ রোগীই লক্ষণহীন থাকেন এবং সাধারণত ঘটনাক্রমে রোগটি নির্ণীত হয়। লিভার ফাংশন টেস্টে অস্বাভাবিকতা বা লিভার সাইজ বড় হওয়া বা অন্য রোগের জন্য পরীক্ষা করার সময়ে বিশেষত আলট্রাসনোগ্রাফির মাধ্যমে রোগটি ধরা পড়ে।
- কারো কারো পেটের ডান উপরি অংশে একটু ভার ভার বা হালকা ব্যথা অনুভূত হতে পারে। কেউ বা শারীরিক দুর্বলতার অভিযোগ করে থাকেন।
- কখনো কখনো রোগী ফ্যাটি লিভার রোগের জটিলতা নিয়ে আসতে পারেন (যেমন লিভার সিরোসিস ও তার জটিলতা সমূহ, লিভার ক্যান্সার ইত্যাদি।)
চিকিৎসা
ফ্যাটি লিভার রোগের চিকিৎসায় দুটি দিক—
১. লিভার রোগের চিকিৎসা
২. রোগটির সন্নিহিত অবস্থাগুলো নির্ণয় ও চিকিৎসা, যেমন- শরীরের স্থূলতা চর্বির আধিক্য, ডায়াবেটিস ইনসুলিন অকার্যকরতা, কার্ডিওভাসলার রোগের ঝুঁকিসমূহ ইত্যাদি।
কী করণীয়?
- বর্তমানে ফ্যাটি লিভারের চিকিৎসা প্রধানত জীবনযাপন পদ্ধতি পরিবর্তনের ওপরই জোর দিয়ে থাকে। শরীরের ওজন কমানো, দৈনন্দিন ব্যায়াম এবং কম ক্যালরিযুক্ত আঁশসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।
- শরীরের ওজন স্বাভাবিক রাখতে সচেষ্ট হতে হবে। অতিরিক্ত ওজন ঝেড়ে ফেলুন। শরীরের ৫-১০% ওজন কমালে লিভারের চর্বি ও চর্বিজনিত প্রদাহ যথেষ্ট পরিমাণে কমে এবং লিভারের এনজাইমগুলো স্বাভাবিক হয়। তবে মনে রাখতে হবে অতি দ্রুত শরীরের ওজন কমানো ঠিক নয়।
- সুষম কম ক্যালরিযুক্ত আঁশসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করুন। যেমন- সবুজ শাকসবজি, ফলমূল, ইত্যাদি। উচ্চ শর্করা বা চর্বিসমৃদ্ধ খাবার যেমন- ঘি, মাখন, পনির, লাল মাংশ, মাছের ডিম, বড় মাছের মাথা বর্জনীয়। এতে শরীরের পরিপাক সঠিক হয় এবং ওজন ঠিক রাখতে সহায়তা করে।
- সর্বোতভাবে নেশাজাতীয় দ্রব্য বর্জন করতে হবে। মদ্যপান ত্যাগ করুন।
- ফাস্টফুড, কার্বোনেটেড চর্বি বা শর্করা সমৃদ্ধ ড্রিংকস, চকলেট বর্জনীয়।
- দৈনিক শারীরিক পরিশ্রম ও ব্যায়াম শরীরের ওজন ও লিভারের চর্বি কমাতে সাহায্য করে।
- রোজ ঘণ্টা খানেক ঘাম ঝরিয়ে হাঁটতে চেষ্টা করুন।
- ডায়াবেটিস অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
ফ্যাটি লিভারের চিকিৎসায় কী ওষুধ ব্যবহার করা হয়?
বিভিন্ন সময়ে নানাবিধ ওষুধ ব্যবহার করা হয়েছে কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে যে কোন ওষুধই জীবনযাপন পদ্ধতি পরিবর্তনের চেয়ে অর্থাৎ দৈনন্দিন ব্যায়াম, খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন ও স্বাভাবিক জীবন যাপনের বেশি কার্যকর নয়। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত ওষুধ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শক্রমে ব্যবহার করা হয় যেমন- ভিটামিন-ই, ওমেগো-৩ ফ্যাটি এসিড ইত্যাদি। রক্তে চর্বির আধিক্য কমাতে স্টাটিন ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
উপসংহার
ফ্যাটি লিভারে রোগ হলে আতংকিত হবার কিছু নেই। খুব কম সংখ্যক রোগীরই জটিলতা তৈরি হয় এবং তা হতে অনেক বছর সময় লাগে। তাই ভালো থাকার জন্য শরীরের ওজন স্বাভাবিক রাখুন। উচ্চ ক্যালরিযুক্ত খাবার বর্জন করুন। দৈনন্দিন ব্যায়ামের অভ্যাস করুন, রোগমুক্তি আসবেই আসবে।
ফ্যাটি লিভার রোগীর কী কী পরীক্ষা করা প্রয়োজন?
১। রক্ত পরীক্ষা : কোন নির্দিষ্ট একটি পরীক্ষার মাধ্যমে রোগটি নির্ণয় করা যায় না। কিছু লিভার এনজাইম যেমন ALT, AST, ALP, GGT মাত্রা বাড়তে পারে। এক্ষেত্রে ALT GbRvBg, AST এর তুলনায় বাড়তি থাকবে, যা অ্যালকোহলিক লিভার রোগের বিপরীত। সন্নিহিত কিছু রক্ত পরীক্ষা যেমন— Viral Marker- HBsAg, Anti HCV, রক্তে চর্বির মাত্রা, রক্তে গ্লুকোজমাত্রা, থাইরয়েড হরমোন ইত্যাদি পরীক্ষা দেখে নেওয়া উচিত।
২। আলট্রাসনোগ্রাফি : এটি ফ্যাটি লিভার নির্ণয়ে অত্যন্ত গুরুত্ব¡পূর্ণ পরীক্ষা।
৩। সিটি স্ক্যান বা এমআরআই : উক্ত পরীক্ষাগুলোর মাধ্যমেও ফ্যাটি লিভার নির্ণয় করা যায়।
৪। ফাইব্রোস্ক্যান লিভার : উক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে লিভারের নমনীয়তা দেখা হয় এবং লিভার কোষের চর্বি জমার আপাত পরিমান নির্ণয় করা যায়। উক্ত পরীক্ষা দ্বারা রোগটির ক্রম অগ্রসরমানতা চেক করা যায়।
৫। লিভার বায়োপসি : এ পরীক্ষাটি গোল্ড স্টান্ডার্ড, যার মাধ্যমে লিভার কোষসমূহে চর্বি, চর্বিজনিত প্রদাহ ও ফাইব্রোসিস ব্যাপ্তি দেখা যায়। কিছু কিছু রোগীর ক্ষেত্রে পরীক্ষাটির প্রয়োজন হয়।

ডাঃ বিমল চন্দ্র শীল
এমবিবিএস, এফসিপিএস (মেডিসিন)
এমডি (গ্যাস্ট্রো), মেম্বার-আইএসজি (ইন্ডিয়া)
ফেলো ইন্টারভেনশনাল গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজি (AIIMS, Delhi)
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, পরিপাকতন্ত্র ও লিভার বিশেষজ্ঞ
সহযোগী অধ্যাপক, গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজি বিভাগ
স্যার সলিমুলাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা।