বাড়ছে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি

বাড়ছে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি

বিশ্বব্যাপী মানবমৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ ক্যানসার। নারী-পুরুষ উভয়ই যেকোনো কানসারে আক্রান্ত হতে পারেন। তবে পুরুষদের মধ্যে ফুসফুস, প্রোস্টেট ও কোলন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার হার বেশি। অন্যদিকে, নারীরা বেশি আক্রান্ত হন স্তন, জরায়ু ও থাইরয়েড ক্যানসারে। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে নারীরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন স্তন ক্যানসারে। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর ১৩ হাজারের বেশি নারী নতুন করে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হন। সচেতনতা ও প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে।

স্তন ক্যানসার কী

ক্যানসার মানেই কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। স্তন ক্যানসারও স্তনের কোনো অংশে কিছু কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির ফল। স্তনের যে অংশে কোষ বৃদ্ধি পায় স স্থানে কোষের অনিয়মিত ও অতিরিক্ত বিভাজনের ফলে টিউমার সৃষ্টি হয়। টিউমারটি রক্তনালি ও লসিকাগ্রন্থি হয়ে স্তনের বাইরে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে এবং ক্যানসারে পরিণত হয়।

লক্ষণ ও উপসর্গ

  • স্তন স্পর্শ করলে ব্যথাহীন শক্ত কোনো চাকা বা দলার মতো অনুভূত হওয়া।
  • স্তনের চারদিক, বগলের ভেতর বা আশপাশের কোনো স্থান ফুলে ওঠা।
  • স্তন ব্যথা হওয়া।
  • স্তনের চামড়া কুঁচকে যাওয়া ও চামড়ার রং পরিবর্তন হয়ে যাওয়া।
  • স্তনের আশপাশ লাল হয়ে যাওয়া।
  • স্তনের আকার পরিবর্তন হয়ে যাওয়া।
  • স্তনের বোঁটা বেঁকে যাওয়া বা ভেতরে ঢুকে যাওয়া।
  • স্তনের বোঁটা দিয়ে রক্ত বা রক্তমিশ্রিত পদার্থ বের হওয়া।

যেসব নারীর স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বেশি

যেকোনো নারীই স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হতে পারেন।
তবে ৪০ বছরের বেশি বয়সী নারীদের মধ্যে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। কোনো নারীর মা, খালা ও বোনের স্তন ক্যানসার থাকলে তাঁরও স্তন ক্যানসার হতে পারে। আরও কিছু কারণে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বেড়ে যায়। যেমন—

  • ১২ বছর বয়সের আগে পিরিয়ড শুরু হলে এবং ৫৫ বছর বয়সের পরেও মেনোপজ না হলে।
  • ৩০ বছর বয়সের পরে সন্তান ধারণ করলে।
  • শিশুকে বুকের দুধ না খাওয়ালে।
  • ধূমপান ও মদ্যপান করলে।
  • পর্যাপ্ত ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রম না করলে।
  • অতিরিক্ত ওজন থাকলে।
  • দীর্ঘদিন জন্মনিরোধক ওষুধ সেবন করলে।
  • দীর্ঘমেয়াদি হরমোন প্রতিস্থাপন থেরাপি নিলে।

এ ছাড়া যাঁদের একবার একদিকের স্তনে ক্যানসার হয়েছে এবং যথাযথ চিকিৎসার পর ভালো আছেন, তাঁদের আবার অন্য স্তন ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

উপসর্গ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে স্তন ক্যানসার পুরোপুরি ভালো হওয়া সম্ভব।

স্তন ক্যানসার নির্ণয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা

স্তনে চাকা বা ব্যথা হলে তা ক্যানসারের পর্যায়ে যাচ্ছে কি না এটা নির্ণয়ের জন্য রোগীর বয়স ও উপসর্গ অনুযায়ী কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়ে থাকে। সাধারণত, ৩৫ বছরের কম বয়সী নারীদের স্তনে চাকা থাকলে আলট্রাসনোগ্রাম করা হয়। ৩৫ বছরের বেশি বয়সী নারীদের করা হয় ম্যামোগ্রাম। কোনো রোগীর স্তনের বোঁটা দিয়ে যদি অস্বাভাবিক রস বের হয় তাহলে সাইটোলজি পরীক্ষা করা জরুরি। এ ছাড়া, স্তনের চাকা থেকে একটু কোষ নিয়ে এফএনএসি (ফাইন নিডল অ্যাসপিরেশন সাইটোলজি) পরীক্ষা করা যেতে পারে। স্তন টিউমার থেকে কোষ নিয়ে মাইক্রোস্কোপের নিচে কোর বায়োপসি পরীক্ষার মাধ্যমেও ক্যানসার শনাক্ত করা যায়। কোর বায়োপসি করলে টিউমারটির বৈশিষ্ট্য জানা যায় এবং সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয় যে আগে কেমোথেরাপি দিতে হবে নাকি আগে সার্জারি করতে হবে। কোর বায়োপসি করার পর ইমিউনোহিস্টোকেমিস্ট্রি করা অত্যন্ত জরুরি।

অস্ত্রোপচার :

প্রাথমিক পর্যায়ে অর্থাৎ ক্যানসার শুধু স্তনে সীমাবদ্ধ থাকলে চিকিৎসার প্রথম ধাপ হিসেবে অস্ত্রোপচার করা হয়। অস্ত্রোপচারের পর কাটা টিউমারটি পরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় রোগীর কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপি লাগবে কি না।

কেমোথেরাপি :

ক্যানসার যদি স্তনের আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে আগে কেমোথেরাপি দিয়ে টিউমারের আকৃতি ছোট করে নেওয়া হয়, তারপর অস্ত্রোপচার করা যেতে পারে।

রেডিওথেরাপি :

ক্যানসার শরীরের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলে অস্ত্রোপচারের আগে রেডিওথেরাপি দেওয়া হয়। অস্ত্রোপচারের পরে প্রয়োজন অনুযায়ী হরমোন থেরাপি ও ইমিউনো থেরাপি দেওয়া প্রয়োজন।
বর্তমানে ব্রেস্ট কনজারভিং সার্জারি পদ্ধতিতে স্তন না কেটেও স্তন ক্যানসারের চিকিৎসা করা যায়।

স্তন ক্যানসার কি পুরোপুরি নিরাময়যোগ্য

স্তন ক্যানসারের যেকোনো উপসর্গ দেখা দিলে যদি সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সঠিক চিকিৎসা নেওয়া হয়, তাহলে স্তন ক্যানসার থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়া সম্ভব। এ জন্য প্রতি মাসে পিরিয়ড শেষ হওয়ার ৩-৪ দিনের মধ্যে বা মাসের একটি নির্দিষ্ট সময়ে নিজে নিজে স্তন পরীক্ষা করতে হবে। যদি কোনো অস্বাভাবিকতা চোখে পড়ে তাহলে দেরি না করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। তাছাড়া নিয়মিত ব্যায়াম, পুষ্টিকর খাবার, ওজন নিয়ন্ত্রণ, ধূমপান ও মদ্যপানের অভ্যাস ত্যাগ, সঠিক বয়সে সন্তান ধারণ, অতিরিক্ত জন্মনিরোধক ওষুধ সেবন না করার মাধ্যমে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি অনেকটাই এড়ানো সম্ভব।

স্তনে চাকা মানেই কি ক্যানসার

বেশির ভাগ নারী স্তনে চাকা হলেই ভয় পেয়ে যান এবং মনে করেন, তাঁর হয়তো স্তন ক্যানসার হয়েছে। কিন্তু এ ধারণা ভুল। অনেক সময় মাসিকের ১৫ দিন আগে স্তনে ব্যথা বা ছোট ছোট চাকা দেখা দিতে পারে, যা স্বাভাবিক। আবার প্রসূতি মায়েদের স্তনে দুধ জমে চাকার মতো হয়; ব্যথাও হতে পারে। এতে ভয় পাবেন না। স্তনে চাকা মানেই টিউমার বা ক্যানসার নয়। তবে যে কারণেই স্তনে চাকা হোক না কেন, এতে অবহেলা করা উচিত নয়। প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিন্ত থাকা ভালো।


ডা. পারভিন আখতার বানু

এমবিবিএস, বোর্ড সার্টিফাইড ইন রেডিয়েশন অনকোলজি (সিরাজ, ইরান)
প্রাক্তন সহকারী অধ্যাপক,
আহওয়াজ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ইরান
প্রাক্তন প্রধান কনসালট্যান্ট, ক্যানসার বিশেষজ্ঞ,
ডেল্টা হাসপাতাল লি.
সিনিয়র কনসালট্যান্ট, ক্লিনিক্যাল অনকোলজি ও উপদেষ্টা,
ল্যাবএইড ক্যানসার হাসপাতাল

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

LinkedIn
Share
WhatsApp