বাতজ্বর থেকে হতে পারে বাতজনিত হৃদ্‌রোগ

বাতজ্বর থেকে হতে পারে বাতজনিত হৃদ্‌রোগ

ডা. এস মোকাদ্দাস হোসেন (সাদী)

৮ বছর বয়সী রোহানের প্রায়ই টনসিলের ব্যথা হয়। কিছুদিন আগে গলাও ব্যথা হয়েছিল খুব। ইদানীং মাঝে মাঝেই তার জ্বর আসছে। একদিন সে প্রচণ্ড জ্বরের সঙ্গে সারা শরীর ও হাড়ে ব্যথা নিয়ে স্কুল থেকে ফিরল। সন্ধ্যায় জ্বরের তাপমাত্রা ও ব্যথা আরও বাড়ল। তার মা খেয়াল করলেন, রোহানের শরীরে লাল লাল চাকার মতো কী যেন হয়েছে। রাতে তার শ্বাসকষ্ট শুরু হলে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। চিকিৎসক পরীক্ষা- নিরীক্ষা করে জানালেন, রোহানের বাতজ্বর হয়েছে। এখনই যথাযথ চিকিৎসার প্রয়োজন। না হলে তার হার্টের সমস্যা হতে পারে।

বাতজ্বর বা রিউমেটিক ফিভার হলো ব্যাকটেরিয়াজনিত একটি রোগ। এতে প্রথমে গলায় ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ঘটে। কয়েক সপ্তাহ পর শরীরের ব্যাকটেরিয়াপ্রতিরোধী অ্যান্টিবডি হৃদ্ যন্ত্র ও শরীরের নানা উপাদানের সঙ্গে প্রতিক্রিয়া করে প্রদাহের সৃষ্টি করে। তারপর ধীরে ধীরে হৃৎপিণ্ড, ত্বক, মস্তিষ্ক আক্রান্ত হয়। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় হৃৎপিণ্ড। বাতজ্বরের কারণে হৃৎপিণ্ডের যে ক্ষতি হয়, তার জন্য দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।

বাতজ্বর থেকে হতে পারে বাতজনিত হৃদ্‌রোগ

কারা বেশি আক্রান্ত হয়

সাধারণত শিশুরা বাতজ্বরে বেশি আক্রান্ত হয়। ৫-১৫ বছর বয়সীদের মধ্যে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার হার বেশি। তবে প্রাপ্তবয়স্করাও বাতজ্বরে আক্রান্ত হতে পারেন। জনবহুল ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাসকারীদের এই রোগ বেশি হয়। উন্নত দেশের তুলনায় উন্নয়নশীল দেশে বাতজ্বরে আক্রান্ত রোগী বেশি। প্রতিবছর প্রায় ১৮ মিলিয়ন মানুষ বাতজনিত হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হন।

কেন হয় বাতজ্বর

বাতজ্বরের প্রধান কারণ স্ট্রেপটোকক্কাস নামক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ। এই ব্যাকটেরিয়ার কারণে গলাব্যথা ও টনসিল ফুলে বাতজ্বরের সূচনা হয়। এ ছাড়া ঠান্ডা ও স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব, খোসপাঁচড়া, অসচেতনতার জন্য এই রোগ অধিক বিস্তার লাভ করে। জিনগত কারণেও বাতজ্বর হয়।.

উপসর্গ

জ্বর, গলাব্যথা, অস্থিসন্ধি বা হাড়ের গিরায় ব্যথা ও ফুলে যাওয়া বাতজ্বরের প্রধান উপসর্গ। এ ছাড়া—

  • হৃৎপিণ্ডে প্রদাহ।
  • বুকব্যথা।
  • বুক ধড়ফড় করা।
  • কাশি হওয়া।
  • শরীরে লাল লাল গোটার মতো ওঠা।শ্বাসকষ্ট।
  • কাঁপুনি।
  • অল্পতেই হাঁপিয়ে ওঠা ও ক্লান্ত বোধ করা।
  • ত্বকের নিচে ব্যথাহীন ছোট ছোট দানা হওয়া—এসবও

বাতজ্বরের লক্ষণ।

বাতজ্বর যেভাবে হৃদ্‌রোগে রূপ নেয়

অনেকে বাতজ্বর ও বাতকে (জুভেনাইল ইডিওপ্যাথিক আর্থ্রাইটিস) এক মনে করেন। কিন্তু বাত হলো শুধু গিরার সমস্যা আর বাতজ্বর হলো গিরার চেয়েও বেশি হার্টের সমস্যা। বাতজ্বর গিরার চেয়ে হার্টের ক্ষতি বেশি করে। বাতজ্বর থেকে হার্টের ভালভের ক্ষতি হয়। আবার অনেকের শরীরে বাতজ্বরের লক্ষণগুলো ভালোভাবে প্রকাশ পায় না। ফলে সঠিক সময়ে চিকিৎসার অভাবে বাতজ্বর হৃদ্‌রোগে পরিণত হয়।

বাতজনিত হৃদ্‌রোগ হলে যা হয়

বাতজ্বর হৃদ্‌রোগে পরিণত হলে রোগীর—

  • শ্বাসকষ্ট হয়।
  • বুক ধড়ফড় করে।
  • কাশির সঙ্গে রক্ত পড়ে।
  • পায়ে পানি জমে পা ফুলে যায়।
  • রোগীর কর্মক্ষমতা কমে যায়।
  • নাড়ির গতি কমে যায়।
  • হাঁপানি হয়।

বাতজ্বরের কারণে হৃৎপিণ্ডের যেসব ক্ষতি হতে পারে

বাতজ্বরের কারণে হৃৎপিণ্ডের ভালভ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভালভ সংকুচিত হয়ে যায়, ফলে রক্ত চলাচল বাধাপ্রাপ্ত হয়। হৃৎপিণ্ডের পেশি দুর্বল হয়ে যায়। হৃৎস্পন্দন অস্বাভাবিক হয়ে পড়ে। হার্টের ভেতর রক্ত জমাট বেঁধে যায়। জমাট বাঁধা রক্ত মস্তিষ্কে গিয়ে রোগীর স্ট্রোক হতে পারে।

প্রতিরোধের উপায়

বাতজ্বর বা বাতজনিত হৃদ্‌রোগ ছোঁয়াচে কোনো রোগ নয়। সচেতনভাবে জীবনযাপন করলে এই রোগ হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়। সে জন্য—

  • ঠান্ডা থেকে সতর্ক থাকতে হবে।
  • বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে।
  • অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এড়িয়ে চলতে হবে।
  • পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে।
  • সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে।

প্রতিরোধের উপায়

বাতজ্বরের চিকিৎসা হলো উচ্চমাত্রার অ্যাসপিরিন, এতে গিরাব্যথা ও ফোলার উন্নতি দেখা যায়। বাতজ্বরের কারণে হার্টের ক্ষতি হলেও চিকিৎসার মাধ্যমে বেশির ভাগ রোগী সুস্থ হয়ে যায়। ইকোকার্ডিওগ্রাফির মাধ্যমে রোগের তীব্রতা বোঝা যায়। তার ওপর ভিত্তি করে রোগীর চিকিৎসা করতে হয়। কার্ডিয়াক ইন্টারভেনশনাল চিকিৎসাপদ্ধতিতে সরু ভালভ প্রসারিত করা হয়। কখনো হার্টে কৃত্রিম ভালভ বসানোর দরকার পড়ে। রোগীকে অনেক দিন পর্যন্ত ওষুধ খেতে হতে পারে। সুস্থ হয়ে যাওয়ার পরও চিকিৎসকের পরামর্শমতো চলতে হবে, কারণ বাতজনিত হৃদ্‌রোগ একবার হলে আবার হওয়ার আশঙ্কা থাকে।


ডা. এস মোকাদ্দাস হোসেন (সাদী)

এমবিবিএস, এফসিপিএস (মেডিসিন), এমডি (কার্ডিওলজি), এফএপিএসআইসি
ফেলোশিপ (সিঙ্গাপুর), জাকার্তা, এফএসসিএআই (ইউএসএ)
সহযোগী অধ্যাপক, কার্ডিওলজি
ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজি অ্যান্ড ইলেকট্রোফিজিওলজি
চেম্বার : ল্যাবএইড লিমিটেড (ডায়াগনস্টিকস) (এনেক্স)

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

LinkedIn
Share
WhatsApp