যকৃত তন্ত্রে যখন সার্জারি
অধ্যাপক জুলফিকার রহমান খান
হেপাটোবিলিয়ারি তন্ত্র মানব দেহের লিভার, গলব্লাডার, পিত্তথলি ও পিত্তনালি এবং অগ্নাশয়কে বুঝায়। এই তিনটি অঙ্গে নানা রকম রোগ হয়। কিছু রোগ ওষুধ দ্বারা চিকিৎসায় রোগী আরোগ্য লাভ করে। আবার কিছু রোগী শৈল্য (সার্জারি) চিকিৎসাতে আরোগ্য লাভ করে। আমরা হেপাটোবিলিয়ারি তন্ত্রের সার্জিক্যাল রোগ নিয়ে আলোচনা করবো।

নিম্নলিখিত রোগের জন্য সার্জারি বা শৈল্যচিকিৎসা করতে হয়।
লিভার
- লিভার টিউমার
- লিভার সিস্ট
- লিভারের ফোঁড়া
- লিভার সিরোসিস
পিত্তথলি-পিত্তনালি
- পিত্তথলির পাথর, ক্যানসার
- পিত্তনালির পাথর, ক্যানসার, সিস্ট।
অগ্নাশয়
- প্রদাহ
- পাথর
- সিস্ট
- টিউমার
লিভার টিউমার ২ ধরনের হয়
১. প্রাথমিক লিভার টিউমার ও ২. সেকেন্ডারি লিভার টিউমার।
প্রাইমারি লিভার টিউমার
এই টিউমার বা ক্যানসার প্রথম থেকেই লিভার এ শুরু হয়। প্রায় ৯০ শতাংশ টিউমার হেপাটসেলুলার ক্যানসার। এই ক্যানসার সাধারণত হেপাটাইটিস বি ও সি দ্বারা আক্রান্ত রোগীর হয়। ফলে হেপাটোসেলুলার বি ভ্যাকসিন দিলে এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। কিন্তু যেহেতু হেপাটাইটিস সি এর জন্য কোন ভ্যাকসিন না থাকতে সি ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত রোগীর টিউমার প্রতিরোধ করা সম্ভব না। এছাড়া যে কোন ক্রনিক লিভার ডিজিস থেকে লিভার টিউমার বা ক্যান্সারের উৎপত্তি হতে পারে। লিভার ক্যানসার দ্বারা আক্রান্ত হলে সর্বপ্রথমে রোগীর খাবারে রুচি ও ওজন কমে যায়। পরবর্তীতে পেটের ডানদিকে উপরের অংশে চাকা দেখা যায়। এমনকি জন্ডিসও হতে পারে। রক্ত পরীক্ষা, আল্ট্রাসাউন্ড অথবা সিটি স্ক্যান করে রোগ নির্ণয় করা যায়। যে কোন টিউমারের মত লিভার টিউমার খুবই প্রাথমিক অবস্থায় রোগ নির্ণয় করতে পারলে অপারেশন করে সম্পূর্ণ রোগ মুক্তি সম্ভব। হেপাটাইটিস বি ও সি আক্রান্ত রোগীদের প্রতি ৬ মাস অন্তর রক্ত পরীক্ষা ও আল্ট্রাসনোগ্রাফি করে প্রাথমিক অবস্থায় লিভার ক্যানসার নির্ণয় সম্ভব।
সেকেন্ডারি লিভার টিউমার
মানব শরীরের অন্য কোন অঙ্গের ক্যানসার লিভারে ছড়িয়ে পড়লে যে টেউমার হয় তাকে সেকেন্ডারি লিভার টিউমার বলা হয়। সাধারণত পাকস্থলী, ক্ষুদ্র ও বৃহদঅন্ত্র, ফুসফুস, কিডনি, স্তন ক্যানসার থেকে সেকেন্ডারি লিভার বি ও সি হয়। এ ক্ষেত্রে লিভার টিউমার যদি খুবই ছোট থাকে তবে অপারেশন করে টিউমার অপারেশন করা সম্ভব। তবে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই অপারেশন করা যায় না। সেক্ষেত্রে কেমোথেরাপি অথবা অন্যান্য পদ্ধতিতে চিকিৎসা করা হয়।
পিত্তথলি ও পিত্তনালির রোগ
পিত্তথলির পাথর সব থেকে কমন রোগগুলোর একটি। লেপারোস্কপির সাহায্যে পিত্তথলির পাথর অপারেশন সব চেয়ে উত্তম চিকিৎসা পদ্ধতি।

পিত্তনালীর পাথর
সাধারণত বেশিরভাগ রোগী পেটে ব্যথা ও জন্ডিস নিয়ে আসে। পিত্তনালির পাথর অপারেশন অথবা ইআরসিপি দুইভাবেই অপসারণ করা যায়।
পিত্তনালির ক্যানসার হলে রোগী সাধারণত জন্ডিস নিয়ে আসে। বেশির ভাগ রোগীর অপারেশন করা যায় না। তবে পিত্তনালীর নিচের দিকে টিউমার হলে অপারেশন করে আরোগ্য লাভ সম্ভব। যেসব রোগী অপারেশন করা যায় না তাদের ERCP মাধ্যমে Stenting করে নিলে জন্ডিস কমে যায়।
পিত্তথলির ক্যানসার
পিত্তথলির ক্যানসার যদি খুবই প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়ে তবে অপারেশন করে আরোগ্য লাভ সম্ভব। তবে বেশীর ভাগ রোগী খুবই শেষ অবস্থায় আসে।
প্যানক্রিয়েজের নানান রোগ
প্যানক্রিয়েজ মানব দেহের একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ডাইজেষ্টিভ অরগান। বাংলায় বলা হয় অগ্নাশয়। প্যানক্রিয়েজ মানব দেহের পেটের ভিতরে পাকস্থলীর পিছনে অবস্থিত। ওজন প্রায় ৮০ গ্রাম । এটি দুই ধরণের রস নিঃসরণ করে। ডাইজেষ্টিভ এনজাইম ও হরমোন। এনজাইম ক্ষুদ্র অন্ত্রে নিঃসরিত হয়। এটি কার্বোহাইড্রেড, ফ্যাট ও প্রোটিনজাতীয় খাদ্য হজমে সাহায্য করে। হরমোনের মধ্যে ইনসুলিন ও গ্লুকাগণ রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। প্যানক্রিয়েজের নানা রকমের রোগ হতে পারে। এর মধ্যে প্যানক্রিয়েজের প্রদাহ, পাথর এবং টিউমার উল্লেখযোগ্য। প্রতিটি রোগ এবং এর চিকিৎসা খুবই জটিল।
প্যানক্রিয়েজের প্রদাহ
প্যানক্রিয়েজে দুই ধরণের প্রদাহ হয়।
১। অতিমাত্রায় প্রদাহ (Acute Pancreatitis) ২। ক্রনিক প্রদাহ (Chronic Pancreatitis)
অতিমাত্রায় প্রদাহ (Acute Pancreatitis)
অতি মাত্রায় প্রদাহের কারণ হচ্ছে পিত্তথলি ও পিত্তনালির পাথর, অতিমাত্রায় মদ্যপান, রক্তে ক্যালসিয়ামের মাত্রা বৃদ্ধি এবং জন্মগত ত্রুটি। এছাড়া কোন নির্দিষ্ট কারণ ছাড়াও এই প্রদাহ হতে পারে।
উপসর্গ
পেটের উপরের দিকে তীব্র ব্যথা শুরু হয় যা পেটের পিছনের দিকে ছড়িয়ে পড়ে, পেটের ব্যথা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে এর সঙ্গে বমি হতে পারে। পেটে ব্যথা এত তীব্র হয় যে রোগী অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে।
রোগ নির্ণয়
রক্ত পরীক্ষাঃ রক্তে অ্যামাইলেজ (Amylase) এর মাত্রা, আল্ট্রাসাউড এবং কোন কোন ক্ষেত্রে সিটি স্ক্যান এবং ইআরসিপি’র (ERCP) মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করা যায়।
চিকিৎসা
প্যানক্রিয়েজের প্রদাহ একটি জটিল রোগ। ইমারজেন্সি চিকিৎসার প্রয়োজন। রোগীকে অবশ্যই কোন হাসপাতালে ভর্তি করে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের মাধ্যমে চিকিৎসা করাতে হবে। কোন কোন ক্ষেত্রে আইসিইউ’র (ICU) সাহায্য লাগতে পারে। ক্ষেত্র বিশেষে অপারেশন প্রয়োজন হতে পারে। যদি প্রদাহ পিত্তথলি ও পিত্তনালীর পাথরের জন্য হয় তবে প্রদাহ কমার পরে সাধারণত চার থেকে ছয় সপ্তাহ পর পিত্তথলির পাথরের অপারেশন করাতে হবে।
ক্রনিক প্রদাহ (প্যানক্রিয়েটাইটিস)
অতিমাত্রার প্রদাহ থেকে ক্রনিক প্যানক্রিয়েটাইটিস হতে পারে। এই ক্ষেত্রে রোগীর ঘন ঘন পেটে ব্যথা হয়। খাদ্য হজম হয় না। ওজন কমে যায়। ফেনাযুক্ত পায়খানা হয়। রোগীর ডায়াবেটিস রোগ হতে পারে।
রোগ নির্ণয়
রক্ত পরীক্ষা, আল্ট্রাসাউন্ড এবং কোন কোন ক্ষেত্রে সিটিস্ক্যান এবং ইআরসিপি (ERCP) এর মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করা যায়।
চিকিৎসা
অবশ্যই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের মাধ্যমে চিকিৎসা করাতে হবে। কোন কোন ক্ষেত্রে অপারেশন করা প্রয়োজন হয়। যদি প্যানক্রিয়েজের নালী বাধাগ্রস্থ হয় তবে অবশ্যই অপারেশন করতে হবে। চর্বি জাতীয় খাবার যেমন- ডিম, দুধ, গরুর মাংস, খাসির মাংস, যে কোন তৈলাক্ত খাদ্য কম খেতে হবে। এছাড়া খাবারের পরিমান কম এবং ক্যালরির মান ঠিক রাখার জন্য অল্প করে বেশী বার খাওয়া যেতে পারে।
প্যানক্রিয়েটিক টিউমার
প্যানক্রিয়েজের টিউমার বেশির ভাগই ক্যানসার হয়। বিনাইন টিউমার খুবই কম। সেজন্য প্যানক্রিয়েজের টিউমার মানেই ক্যানসার। মাঝ বয়েসী পুরুষ এবং মহিলা সমান হারে আক্রান্ত হতে পারে। প্যানক্রিয়েজের টিউমার সাধারনত দুই ধরনের হয়। মাথা (Head) এবং বডি (Body) তে টিউমার হয়। বেশির ভাগ টিউমার মাথাতে আক্রান্ত হয়। প্যানক্রিয়েজের মাথায় টিউমারের রোগী জন্ডিস পেটে ব্যথা, পেটে চাকা নিয়ে আসে। বেশির ভাগই রোগীর রোগ ডায়াগনোসিস হয় অগ্রসর (Advanced Stage) পর্যায়।
রোগ নির্ণয়
প্রাথমিক ইতিহাস, রক্ত পরীক্ষা, আল্ট্রাসাউন্ড, সিটিস্ক্যান, এমআরআই এবং ইআরসিপি’র মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করা যায়।
চিকিৎসা
টিউমার যদি খুব প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়ে তবে অপারেশন করে সম্পূর্ণ রোগ উপশম করা সম্ভব। তবে দেখা গেছে বেশীর ভাগ রোগীই শেষ অবস্থায় আসে। তখন সার্জারীর ভূমিকা খুবই কম থাকে। অপারেশন খুবই জটিল। অবশ্যই বিশেষজ্ঞ সার্জন দ্বারা করা উচিত। অপারেশন দুই ধরনের- কিউরেটিভ এবং পেলিয়েটিভ (Palliative) অপারেশন। কিউরেটিভ (Curative) অপারেশন করতে পারলে সম্পূর্ন আরোগ্য লাভ সম্ভব। পেলিয়েটিভ অপারেশনে আরোগ্য লাভ সম্ভব নয়। তবে কিছু কিছু উপসর্গ যেমন- জন্ডিস, খাদ্য নালী অবষ্ট্রাকশন থেকে সাময়িক নিরাময় হয়। এছাড়া ERCP এর মাধ্যমে Stenting করালে সাময়িক উপশম লাভ করা যায়।
প্যানক্রিয়েজ এবং ডায়াবেটিস
প্যানক্রিয়েজের মধ্যে আইলেট সেল নামক কিছু কোষ থাকে। এই কোষ গুলো ইনসুলিন নামক হরমোন নিঃসরন করে। ইনসুলিন রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। এই কোষগুলো যদি ক্ষতিগ্রস্থ হয় তবে ইনসুলিন এর নিঃসরণ কম হবে ফলে রোগীর ডায়াবেটিস রোগ দেখা দিবে। ক্রনিক প্রদাহ বা সার্জারী করে প্যানক্রিয়েজের টিউমার অপসারন করা হলে রোগী ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
প্যানক্রিয়েজ এবং জন্ডিস
পিত্তনালীর নিম্ন অংশ প্যানক্রিয়েজের মাথার মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হয়। যদি প্যানক্রিয়েজের মাথাতে কোন টিউমার হয় তবে অতিরিক্ত চাপে পিত্ত নালীর প্রবাহ বাধা গ্রস্থ হয়। ফলে রোগীর জন্ডিস হয়। কোন রোগীর জন্ডিস হলে অবশ্যই রক্ত পরীক্ষা এবং আল্ট্রাসাউন্ড করে সঠিক রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা করাতে হবে। পিত্ত নালীর প্রবাহ বাধা গ্রস্থের ফলে যে জন্ডিস হয় তাকে সার্জিকেল জন্ডিস বলে।

প্যানক্রিয়েজের পাথর
ক্রনিক প্যানক্রিয়েটাইটিস থেকে পাথর হতে পারে। রোগীর পেটে মাঝে মাঝে তীব্র ব্যথা হয়। খাদ্য হজম হয় না। ডায়াবেটিস দেখা যায়।
রোগ নির্ণয়
পেটের এক্স-রে, আল্ট্রাসাউন্ড এবং কোন কোন ক্ষেত্রে ইআরসিপি করে রোগ নির্ণয় করা যায়।
চিকিৎসা
যদি খুব ঘন ঘন পেটে ব্যথা হয় তবে অপারেশন করে রোগী লাভবান হয়। রোগটি জটিল বিধায় অপারেশন বিশেষজ্ঞ সার্জন দ্বারা করা উচিত।
উপসংহার
প্যানক্রিয়েজ মানব দেহের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্পর্শকাতর অরগান। এর প্রতিটি রোগই অত্যন্ত জটিল। চিকিৎসাও খুব ব্যয়বহুল এবং জটিল। বর্তমানে আমাদের দেশে এর প্রতিটি রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা সম্ভব।

অধ্যাপক জুলফিকার রহমান খান
এফসিপিএস (সার্জারি), এফআরসিএস (ইউকে)
অধ্যাপক, হেপাটোবিলিয়ারি ও প্যানক্রিয়াটিক সার্জারি বিভাগ
লিভার, প্যানক্রিয়েটিক, বিলিয়ারি এবং ল্যাপারোস্কপিক সার্জন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।