যে লক্ষণ দেখলে হৃদ্রোগীকে হাসপাতালে নেবেন
ডা. মামুনুর রশিদ সিকদার
হার্ট অ্যাটাকের পরবর্তী এক ঘণ্টাকে বলা হয় ‘গোল্ডেন আওয়ার’। এ সময়ের মধ্যে হৃদ্রোগীকে হাসপাতালে নিতে পারলে জীবন বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। কিন্তু হার্ট অ্যাটাকের ব্যথাকে অনেকে গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা ভেবে হাসপাতালে যেতে গড়িমসি করেন। ফলে, আরো বেশি জটিলতা তৈরি হয়। আমাদের দেশে প্রতিদিন প্রায় ৪০০ মানুষ মারা যান হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে। কারণ হিসেবে দেখা যায়, হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ দেখা দিলেও সঠিক সময়ে চিকিৎসা গ্রহণ না করা। খেয়াল রাখবেন, হার্ট অ্যাটাক হওয়ার জন্য আগে থেকে অসুস্থ থাকা জরুরি না, আপাতদৃষ্টিতে একজন সুস্থ মানুষও আকস্মিক হৃদ্রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। তাই হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ দেখা দিলে সময় ক্ষেপণ না করে হৃদ্রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিন এবং ঝুঁকি এড়িয়ে চলুন।
বুকে চাপ ধরা অনুভূতি ও ব্যথা
হৃদ্রোগে আক্রান্ত হলে রোগীর কাছে মনে হতে পারে বুকের ওপর ভারী কিছু চেপে বসেছে। আবার, কারো ক্ষেত্রে বুকে জ্বালাপোড়া দেখা দিতে পারে। ঘুমন্ত অবস্থায় বুকে তীব্র ব্যথা নিয়ে জেগে উঠতে পারেন। মুখ হাঁ করে শ্বাস নেওয়ার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। এসব লক্ষণ দেখা দিলে অবহেলা করবেন না। এগুলো হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ। এমন পরিস্থিতিতে মৃত্যুঝুঁকি এড়াতে হৃদ্রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিন।
বদহজম, বমি বমি ভাব, অম্বল ও পেটে ব্যথা
হার্ট অ্যাটাক হলে ঘন ঘন বমি হওয়া, পেটে ব্যথা, অম্বল কিংবা বদহজমের মতো কিছু লক্ষণ দেখা দিতে পারে। কখনো পেটে ব্যথা বা বদহজমের সমস্যা শুধু খাবারের প্রতিক্রিয়া থেকেও হতে পারে। তবে আগে হার্ট অ্যাটাক হয়ে থাকলে এসব লক্ষণে মোটেই অবহেলা করবেন না।
বুকের ব্যথা ক্রমেই বাহুতে ছড়িয়ে যাওয়া
সাধারণত হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ হিসেবে বুকে তীব্র ব্যথা শুরু হয়। এই ব্যথা ক্রমেই শরীরে ছড়িয়ে যেতে থাকে, বিশেষ করে বাহুর দিকে। আবার, কারো ক্ষেত্রে বুকে ব্যথা ছাড়াই শুধু বাহুতে ব্যথা অনুভব হতে পারে।
মাথা ঘোরা, মাথাব্যথা ও জ্ঞান হারানো
অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, খাদ্যাভ্যাস কিংবা কোনো অসুস্থতাজনিত সমস্যায় মাথাব্যথা, মাথা ঘোরা ও মূর্ছা যাওয়ার মতো সমস্যা হতে পারে। আবার, কখনো এগুলো হতে পারে হার্ট অ্যাটাকের পূর্বসংকেত হিসেবেও। এসবের পাশাপাশি বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, অস্থিরতা, হাঁসফাঁস অনুভূতি দেখা দিলে সতর্ক হোন। মৃত্যুঝুঁকি এড়াতে, সময় নষ্ট না করে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিন।
গলা ও চোয়ালের ব্যথা
স্বভাবত গলা ও চোয়ালের ব্যথা হয়ে থাকে সাইনাস, মাংসপেশির সমস্যা কিংবা ঠান্ডাজনিত সমস্যায়। কিন্তু বুকের ব্যথা ক্রমশ গলা ও চোয়ালের দিকে ছড়িয়ে যেতে থাকলে, তা হতে পারে হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ।
আকস্মিক অস্থিরতা বা তাড়াতাড়ি ক্লান্ত হয়ে পড়া
এমন কিছু স্বাভাবিক কাজকর্ম আছে, যা নিত্যদিন করে থাকেন, যেমন—সিঁড়ি ভেঙে ওপরে ওঠা কিংবা বাজারের ব্যাগ বহন করা। এসব কাজে হঠাৎ করে প্রচণ্ড ক্লান্তি অনুভব করা, হাঁপিয়ে ওঠা ও অস্থিরতা দেখা দিলে সতর্ক হোন। হতে পারে এসব লক্ষণ হার্ট অ্যাটাকের পূর্বসংকেত।
অতিরিক্ত ঘাম
স্বাভাবিক তাপমাত্রায় শরীরে অতিরিক্ত ঘাম দেখা দেওয়া স্বাভাবিক ঘটনা নয়। এটি হতে পারে হার্ট অ্যাটাকের পূর্বলক্ষণ। পাশাপাশি বুকব্যথা ও বুক ধড়ফড় শুরু হলে হৃদ্রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে চলুন।
অনবরত কাশি
কাশি সব সময় হৃদ্রোগের লক্ষণ নাও হতে পারে। কিন্তু দীর্ঘ কাশি এবং কাশির সঙ্গে সাদা ও গোলাপি রঙের শ্লেষ্মা বের হলে তা হতে পারে হার্ট ফেইলিওরের একটি লক্ষণ। অনেক সময় কাশির সঙ্গে রক্ত আসতে পারে। এসব লক্ষণ দেখা দিলে অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।
পা, পায়ের পাতা ও গোড়ালি ফুলে যাওয়া
হার্ট ফেইলিওর হলে কিডনির পরিশোধন প্রক্রিয়াতে জটিলতা তৈরি হয়। যেমন, কিডনি শরীর থেকে অতিরিক্ত পানি ও সোডিয়াম অপসারণ করতে পারে না। ফলে পা, পায়ের পাতা ও গোড়ালিতে পানি জমে তা ফুলে ওঠে।
অনিয়মিত হৃৎস্পন্দন
ভয়, রাগ বা কোনো কিছু নিয়ে অতিরিক্ত উত্তেজিত হওয়ার ফলে হৎস্পন্দনের পরিবর্তন ঘটা স্বাভাবিক। তবে, এর পাশাপাশি শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যথা ও বুকে চাপ অনুভব করা এবং মাথা ঘোরা শুরু হলে তা হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ হতে পারে।
শ্বাসকষ্ট ও দম ফুরিয়ে যাওয়া
হৃদ্রোগের কারণে ফুসফুসে জমা হওয়া পানির কারণে শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে। যদি আগে থেকে শ্বাসকষ্ট না থাকে এবং হঠাৎ করে শ্বাস নিতে সমস্যা দেখা দেয়, তবে সেটা খারাপ লক্ষণ। এ ক্ষেত্রে অল্পতে দম ফুরিয়ে যাওয়া এবং মুখ দিয়ে শ্বাস নেওয়ার মতো সমস্যাও দেখা দিতে পারে।
হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ দেখা দিলে সময়মতো রোগীকে হাসপাতালে নিতে হবে। হাসপাতালে যেতে দেরি হলে বা সময়মতো চিকিৎসা না পেলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। তাই হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখুন। মৃত্যুঝুঁকি এড়িয়ে চলুন।
ডা. মামুনুর রশিদ সিকদার
এমবিবিএস (ঢাকা), বিসিএস (স্বাস্থ্য)
এমসিপিএস (মেডিসিন), এফসিপিএস (কার্ডিওলজি)
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও কার্ডিওলজিস্ট
সহকারী অধ্যাপক (কার্ডিওলজি)
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল, ঢাকা
চেম্বার : ল্যাবএইড লিমিটেড (ডায়াগনস্টিকস), মিরপুর