লিভার ক্যান্সার: শেষ হয়নি আশা

লিভার ক্যান্সার: শেষ হয়নি আশা

ডাঃ মামুন-আল-মাহতাব (স্বপ্নীল)

ক্যান্সার মানেই আতঙ্ক, আর তা যদি হয় লিভার ক্যান্সার তাহলেতো কথাই নেই। এ কথা সত্যি যে, শরীরের বেশীর ভাগ ক্যান্সারের মতই লিভার ক্যান্সার নিরাময় এখনও আমাদের সাধ্যের অতীত। তবে পাশাপাশি একথাও সত্যি, লিভার ক্যান্সার চিকিৎসায় সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের অগ্রগতিও কম নয়। সবচেয়ে বড় কথা, আজ বাংলাদেশে বসেই লিভার ক্যান্সারের আধুনিক চিকিৎসাগুলো পাওয়া সম্ভব। আর সেই সব আশার কথা নিয়েই লেখাটি।  

লিভার ক্যান্সার কেন হয়?

সারা পৃথিবীতেই লিভার ক্যান্সার, ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। প্রতি বছর পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে চার লক্ষ লোক এ রোগে আক্রান্ত হন। পুরুষদের ক্ষেত্রে মোট ক্যান্সারের ৭.৫ ভাগ লিভার ক্যান্সার, আর মহিলাদের বেলায় এ সংখ্যাটি ৩.২ ভাগ। আশঙ্কাজনক সত্যটি এই যে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় লিভার ক্যান্সারের প্রাদুর্ভাব পৃথিবীর অন্য যে কোন অঞ্চলের চেয়ে অনেক বেশী। তাছাড়া আমাদের সাম্প্রতিক গবেষণায় আমরা দেখতে পেয়েছি যে, বাংলাদেশে রোগীরা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় গড়ে প্রায় ২০ বছর কম বয়সে লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। এদেশে ক্যান্সারে মৃত্যুর তৃতীয় প্রধান কারণ লিভার ক্যান্সার।

বিশ্বব্যাপি লিভার ক্যান্সারের মূল কারণ হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস আর এ্যালকোহল। আমাদের দেশে অবশ্য হেপাটাইটিস বি আসল খলনায়ক, কারণ এদেশে প্রায় ৮০ লক্ষ লোক এ ভাইরাসের বাহক বা HBsAg পজেটিভ। হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত ৫ থেকে ১০ শতাংশ লোক জীবনের কোন এক পর্যায়ে এ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন।

লিভার ক্যান্সারের লক্ষণ

যে কোন বয়সের লোকই এ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। লিভার ক্যান্সারের ঝুকি পুরুষদের ক্ষেত্রে মহিলাদের চেয়ে ৪ থেকে ৬ গুণ বেশী। সাধারণতঃ ক্যান্সার হওয়ার আগে লিভারে সিরোসিস দেখা দেয়, তবে এর ব্যতিক্রম হওয়াটাও অস্বাভাবিক না।

লিভার ক্যান্সারের রোগীরা প্রায়ই পেটের ডান পাশে উপরের দিকে অথবা বুকের ঠিক নীচে মাঝ বরাবর ব্যথা অনুভব করেন যার তীব্রতা রোগী ভেদে বিভিন্ন রকম। সহজেই ক্লান্ত হয়ে পরা, পেট ফাপা, ওজন কমে যাওয়া আর হালকা জ্বর জ্বর ভাব এ রোগের অন্যতম লক্ষণ।

লিভার ক্যান্সার রোগীদের প্রায়ই জন্ডিস থাকে না, আর থাকলেও তা খুবই অল্প। রোগীদের খাওয়ায় অরুচি, অতিরিক্ত গ্যাস কিংবা কষা পায়খানার উপসর্গ থাকতে পারে- আবার কখনো দেখা দেয় ডায়রিয়া। পেটে পানি থাকতেও পারে, আবার নাও থাকতে পারে।

লিভার ক্যান্সার নির্ণয়

লিভার ক্যান্সার নির্ণয়ে সহজ উপায় একটি নির্ভরযোগ্য আল্ট্রাসনোগ্রাম। তবে কখনো কখনো সিটি-স্ক্যানেরও দরকার পরে। রক্তের অঋচ পরীক্ষাটি লিভার ক্যান্সারের একটি মোটামুটি নির্ভরযোগ্য টিউমার মার্কার। লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত যে কোন ব্যক্তিরই উচিত প্রতি ৬ মাসে একবার অঋচ ও আল্ট্রাসনোগ্রাম পরীক্ষা করা। তবে লিভার ক্যান্সারের ডায়াগনোসিস কনফার্ম করতে হলে আল্ট্রাসনোগ্রাম গাইডেড FNAC অত্যন্ত জরুরি আর অভিজ্ঞ হাতের সাফল্যের হারও প্রায় শতভাগ।

শুরুতেই যেমনটি বলেছি লিভার ক্যান্সারে আশার এখন শেষ নয়, বরং শুরু। শুরুতে ধরা পরলে আর আকারে ছোট থাকলে অপারেশনের মাধ্যমে এই টিউমার লিভার থেকে কেঁটে বাদ দেয়া যায়। আর এর জন্য প্রয়োজনীয় কুসা মেশিন ও দক্ষ হেপাটোবিলিয়ারি সার্জন এদেশেই বর্তমান।

পাশাপাশি আছে বিনা অপারেশনে টিউমার অ্যাবলেশন বা টিউমারকে পুরিয়ে দেয়া। নামমাত্র খরচে আল্ট্রাসনোগ্রাম গাইডে আমাদের দেশে এখন অহরহই লিভার ক্যান্সারের রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি অ্যাবলেশন আমরা করছি। পাশাপাশি গরীব রোগীদের জন্য আল্ট্রাসনোগ্রাম গাইডে সস্তায় অ্যালকোহল দিয়েও অ্যাবলেশন বা টিউমার পুড়িয়ে ছোট করে দেয়া সম্ভব। আছে আরও কিছু আশা। যেমন এসেছে আগের চেয়ে অনেক বেশী কার্যকর, কিন্তু অনেক কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কেমোথেরাপি জেলোডা ও সুরাফিনেব। এই দুটি ওষুধই আমাদের দেশে তৈরিও হচ্ছে। আর এসব দিয়ে আমরা লিভার ক্যান্সারের রোগীদের চিকিৎসা এদেশে নিয়মিতই করছি। আর তাই লিভারের ক্যান্সারে শেষ হয়নি আশা।


অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

ডাঃ মামুন-আল-মাহতাব (স্বপ্নীল)

সহযোগী অধ্যাপক, লিভার বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
লিভার, গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিশেষজ্ঞ
ইন্টারভেনশনাল এন্ডোস্কোপিস্ট
ল্যাব এইড স্পেশালাইজড হসপিটাল

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

LinkedIn
Share
WhatsApp