শিশুদের ডায়াবেটিস ও প্রতিরোধে করণীয়
অধ্যাপক ডা. মোঃ রুহুল আমিন
সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া শিশুটিও ডায়াবেটিস নিয়ে জন্মাতে পারে। বয়স্কদের মধ্যে আক্রান্তের হার বেশি থাকলেও ডায়াবেটিস হতে পারে যেকোনো বয়সে। বর্তমানে শিশুদের মধ্যেও বাড়ছে ডায়াবেটিস। বেশির ভাগ শিশু শৈশবে টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলেও বিগত বছরগুলোতে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা। তবু শিশুদের ডায়াবেটিসের ব্যাপারে সামাজিক সচেতনতার বেশ অভাব লক্ষ করা যায়। যার ফলে অনেক ক্ষেত্রেই রোগনির্ণয় যেমন বিলম্বিত হয়, ঠিক তেমনি এতে জটিলতাও অনেকাংশে বেড়ে যায়।
ডায়াবেটিস কী
ডায়াবেটিস শরীরের একটি বিপাকজনিত সমস্যা, এই রোগে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে বৃদ্ধি পায়। এটি ইনসুলিন নামক হরমোনের অভাবে অথবা এর কর্মক্ষমতা লোপ পাওয়ার জন্য হয়ে থাকে। আমাদের দেহের অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন নামক হরমোনটি নিঃসৃত হয়, যা বিপাক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেহের শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। ইনসুলিনের কাজ হলো গ্লুকোজকে মানুষের দেহের কোষে পৌঁছে দেওয়া। এরপর সেই গ্লুকোজ ব্যবহার করে শরীরের কোষগুলো শক্তি উৎপাদন করে। কিন্তু যখন ইনসুলিনের উৎপাদন কমে যায় বা ইনসুলিন উৎপাদন হওয়ার পরও যখন তা ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না, তখন শরীরে অতিরিক্ত গ্লুকোজ থাকে। খালি পেটে যদি গ্লুকোজের মাত্রা ৭-এর বেশি থাকে আর খাওয়ার পর যদি ১১-এর বেশি থাকে, তখন সেই অবস্থাকে ডায়াবেটিস বলে।
শিশুদের ডায়াবেটিসের ধরন :
নিওনেটাল ডায়াবেটিস
শিশুর জন্মের পর থেকে ৬ মাস বয়সের মধ্যে যে ডায়াবেটিস হয়, তাকে বলা হয় নিওনেটাল ডায়াবেটিস। সাধারণত জেনেটিক মিউটেশন বা ত্রুটির কারণে এই ডায়াবেটিস হয়ে থাকে।
বয়ঃসন্ধিকালের ডায়াবেটিস বা মডি
সাধারণত বয়ঃসন্ধিকালের শুরুতে এই ধরনের ডায়াবেটিস হয়ে থাকে তাই একে ম্যাচিউরিটি-অনসেট ডায়াবেটিস অব দ্য ইয়াং (মডি) বা বয়ঃসন্ধিকালীন ডায়াবেটিস বলা হয়। এটিও জেনেটিক মিউটেশন বা ত্রুটির কারণে হয়ে থাকে।
টাইপ-১ ডায়াবেটিস
সাধারণত শিশুরা টাইপ-১ ডায়াবেটিসে বেশি আক্রান্ত হয়। বংশগত ও পারিপার্শ্বিক নানা কারণে এই ডায়াবেটিস হতে পারে। এতে একধরনের ইমিউন সিস্টেম (রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা) জটিলতায় দেহের অগ্ন্যাশয়ের বিটা কোষগুলো দ্রুত ধ্বংস হয়ে ইনসুলিন উৎপাদনের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এতে আক্রান্ত শিশুরা দিন দিন শুকিয়ে যায়, ঘন ঘন প্রস্রাব করে আর দ্রুত অসুস্থ হয়ে পড়ে। এ ধরনের ডায়াবেটিসে আজীবন ইনসুলিনের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়।
টাইপ-২ ডায়াবেটিস
শরীরে ইনসুলিন উৎপন্ন হওয়া সত্ত্বেও যখন তা ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না, তখন এই ডায়াবেটিস হয়ে থাকে। শিশুদের মধ্যে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের একক প্রধান কারণ হলো অতিরিক্ত ওজন। যাদের ওজন বেশি, শরীরে অতিমাত্রায় মেদ, কায়িক পরিশ্রম করেন না—তাদের এ রোগ হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। তবে উভয় ক্ষেত্রেই কিছু জিনগত বৈশিষ্ট্য এ রোগ হওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
শিশুদের ডায়াবেটিসের লক্ষণসমূহ
- ঘন ঘন প্রস্রাব ও প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া।
- বিছানায় প্রস্রাব করা বন্ধ হওয়ার পর, পুনরায় ঘুমের মধ্যে প্রস্রাব করা।
- অতিরিক্ত দুর্বলতা ও সারাক্ষণ ঘুম ঘুম ভাব।
- প্রচণ্ড পিপাসা ও ঘন ঘন ক্ষুধা লাগা।
- ঘা শুকাতে বেশি সময় লাগা।
- শিশুর শারীরিক বৃদ্ধিতে সমস্যা।
- ওজন হ্রাস পাওয়া এবং উৎসাহ-উদ্দীপনা কমে যাওয়া।
- শুষ্ক ত্বক ও দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পাওয়া।
- পা অবশ বোধ হওয়া বা ঝিমঝিম করা, মনোযোগ হ্রাস পাওয়া।
- ঘন ঘন বমি ও পেটের পীড়া ইত্যাদি।
শিশুদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ
- শিশুর ডায়াবেটিসের ব্যাপারে নিশ্চিত হলে ভেঙে না পড়ে মনোবল দৃঢ় করতে হবে এবং সঠিকভাবে সন্তানের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে মনোযোগী হতে হবে।
- প্রথমেই পুষ্টিবিদ ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে একটি খাদ্যতালিকা তৈরি করে নিতে হবে, কারণ খাদ্য নিয়ন্ত্রণের ওপর ডায়াবেটিসের নিয়ন্ত্রণ অনেকটা নির্ভরশীল।
- ডায়াবেটিসে আক্রান্ত শিশুদের জন্য অধিক আঁশ ও শর্করাযুক্ত সুষম স্বাস্থ্যকর খাদ্যতালিকা তৈরি করতে হবে, যা শিশুর রক্তের সুগার লেভেল ঠিক রাখবে এবং শিশুর শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধিকেও ব্যাহত করবে না।
- সন্তান স্কুলে যাওয়ার সময় তার পকেটে বা ব্যাগে মিষ্টি জাতীয় খাবার রেখে দিতে হবে। স্কুলের শিক্ষকদেরও এ ব্যাপারে অবহিত করতে হবে।
- সঠিকভাবে ইনসুলিন প্রয়োগবিধি জানতে হবে এবং শিশুকে তা উপযুক্ত বয়সে শেখাতে হবে।
- মুটিয়ে যাওয়া বা স্থূলতা ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়। শুয়ে-বসে, টিভি দেখে, কম্পিউটার গেমস খেলে সময় কাটানোর চেয়ে বাইরের খেলাধুলার দিকে সন্তানকে আকৃষ্ট করতে হবে।
- বাবা-মাকে সন্তানের স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়ে অধিক সতর্ক থাকতে হবে। ডায়াবেটিসের লক্ষণ ও উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত একজন ডায়াবেটিস ও হরমোন রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন এবং সুচিকিৎসা গ্রহণ করুন।
অধ্যাপক ডা. মোঃ রুহুল আমিন
এমবিবিএস, বিসিএস (স্বাস্থ্য), এমডি (ইএম-বিএসএমএমইউ)
ডায়াবেটিস, থাইরয়েড ও হরমোন বিশেষজ্ঞ
অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান (প্রাক্তন), এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ,
ঢাকা মেডিকেল কলেজ
চেম্বার : ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল, ধানমন্ডি