অধ্যাপক মেজর (অব.) ডা. এম মোতাহার হোসেন
নাক-কান-গলা; শীতকাল এলে দেহের এই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ তিনটি তুলনামূলকভাবে আগে আক্রান্ত হয়। হুটহাট নাক বন্ধ হয়ে যায়, কানে ব্যথা হয়, গলা ফুলে যায়। অনেকের ক্ষেত্রেই দেখা যায়, কানব্যথা, গলাব্যথা বা নাক বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে রাত জেগে বসে আছেন। ঘুমোতে পারছেন না। এদিকে শরীরের এই তিনটি অঙ্গ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। একটিতে সমস্যা দেখা দিলে স্বাভাবিকভাবেই তার প্রভাব অন্য অঙ্গগুলোর ওপর পড়ে।
শীতে নাকের সমস্যা
সাইনোসাইটিস
নাকের পেছনে ও মাথার খুলির ভেতরের ফাঁকা জায়গাকে সাইনাস বলে। দেহে বাতাস চলাচলে সাহায্য করে এটি। ঠান্ডা হাওয়া ও ধুলোবালি নাক-মুখ দিয়ে প্রবেশ করে এতে প্রদাহের সৃষ্টি করে। যাকে বলা হয় সাইনোসাইটিস। এটি আক্রান্ত হলে নাক বন্ধ হয়ে যায়, সর্দি হয় এবং নাকে-মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা হয়।
সুরক্ষায় করণীয়
• দূষিত পরিবেশ থেকে দূরে থাকুন।
• ধূমপান পরিত্যাগ করুন।
• ঘুমানোর সময় মাথা উঁচুতে রেখে ঘুমান।
• সরাসরি ফ্যানের নিচে বা এসি বরাবর অবস্থান করবেন না।
• বেশি অসুবিধা হলে গরম ভাপ বা মেনথলের ভাপ নিতে পারেন।
• নাকে যেন কোনোভাবে আঘাত না লাগে, সেটি খেয়াল রাখতে হবে।
• অ্যারোসল, মশার কয়েলের ধোঁয়া ও বিভিন্ন স্প্রে থেকে দূরে থাকুন।
• বাইরে বের হলে মাস্ক ব্যবহার করুন।
ঠান্ডা হাওয়া ও ধুলোবালি নাক-মুখ দিয়ে প্রবেশ করে
প্রদাহের সৃষ্টি করে।
যাকে বলা হয় সাইনোসাইটিস।
সর্দি-কাশি, অ্যালার্জিক রাইনাইটিস, নাক বন্ধ
শীতের সময় ঠান্ডা বা ফ্লুর কারণে সর্দি- কাশি হয়ে থাকে। অ্যালার্জির কারণেও সর্দি-কাশি হতে পারে, যাকে অ্যালার্জিক রাইনাইটিস বলে। এক্ষেত্রে অনবরত হাঁচি, নাক চুলকানো, নাক দিয়ে পানি পড়ার মতো সমস্যা হয়। অনেক সময় চোখ দিয়েও পানি পড়ে এবং চোখ লাল হয়ে যায়।
সুরক্ষায় করণীয়
• অ্যালার্জি উৎপাদনকারী খাবার এড়িয়ে চলুন।
• ঠান্ডা লাগতে দেবেন না।
• ধুলোবালি বা দূষিত পরিবেশ এড়িয়ে চলুন।
• কাশির সঙ্গে রক্ত বের হলে কিংবা জ্বরের প্রকোপ বেশি থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
কণ্ঠনালিতে সমস্যা
অনেক সময় নাকের সমস্যা স্বরনালিতে ছড়িয়ে যায়। তখন গলার স্বর বসে যায় এবং কথা বলতে অসুবিধা হয়। ফ্যাসফ্যাসে আওয়াজ হয়।
সুরক্ষায় করণীয়
• এ সমস্যায় হালকা গরম লেবুপানি ও আদা বেশ উপকারী।
• লবণ-পানি দিয়ে গড়গড়া করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
• কিছুদিন কথা বলা বা কণ্ঠের ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে বন্ধ রাখা ভালো।
নাক দিয়ে রক্ত পড়া
শীতকালে বাতাসের আর্দ্রতা কমে গিয়ে নাকের ভেতরের পাতলা ত্বক ফেটে যায়। সেখান থেকে রক্তপাত হয়ে থাকে। আবার শুষ্ক বাতাসের ফলে মানুষের নাকে এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি হয়। ফলে অনেকেই বারবার নাকে হাত দেয় বা নাক খোঁচায়। তখনো রক্তপাত হতে পারে।
সুরক্ষায় করণীয়
• এ সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে বাসস্থানের শুষ্কতা দূর করার ব্যবস্থা করতে হবে।
• নাকে হাত দেওয়া বা নাক খোঁচানো থেকে বিরত থাকতে হবে।
• রক্তক্ষরণ হলে মাথা সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে রাখুন।
শীতে গলার সমস্যা
টনসিল
শরীরের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো টনসিল। দেহে শ্বেত রক্তকণিকা উৎপন্ন করে থাকে এটি। যা বাইরে থেকে দেহে প্রবেশকারী জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করে। কখনো কখনো এসব জীবাণুকে ধ্বংস করতে গিয়ে টনসিলগ্রন্থি নিজেই আক্রান্ত হয়ে পড়ে। তখন ইনফেকশন হয়ে গ্রন্থি ফুলে যায়। যাকে টনসিলাইটিস বলে। এ সময় গলাব্যথার পাশাপাশি খাবার গিলতে ব্যথা হয়। গলার স্বরে পরিবর্তন আসে।
সুরক্ষায় করণীয়
• হালকা গরম পানিতে লেবুর রস, মধু ও সামান্য লবণ মিশিয়ে সেবন করুন।
• হলুদ মেশানো দুধও বেশ উপকারে আসে।
• ব্যথা মারাত্মক হলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
গলাব্যথা
শীতে ঠান্ডা, ফ্লু, মনোক্লিওসিস প্রভৃতি ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে গলাব্যথা হয়ে থাকে। অ্যালার্জিজনিত সমস্যা, শুষ্ক আবহাওয়া, ধূমপান, মাফলার বা চাদর ব্যবহারে গলার মাংসপেশিতে চাপ লাগা প্রভৃতি কারণেও গলাব্যথা হতে পারে।
• ধূমপান পরিহার করুন।
• হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় রুমাল বা টিস্যু ব্যবহার করুন।
• গরম পানি ও লবণ দিয়ে গার্গল করুন।
শীতে কানের সমস্যা
কান বন্ধ-কানে ব্যথা
ঠান্ডার কারণে অনেক সময় কান বন্ধ হয়ে যায়। যাকে আমরা কানে তালা লাগা বলি। তখন কানে কম শোনা যায়, ব্যথাও হয়।
পর্দা ফাটা
অনেক সময় কানের পর্দা ফেটে গিয়ে পুঁজ বা পানি বের হয়। কানের পর্দার ভেতরের দিকে প্রদাহ সৃষ্টি হয়ে সমস্যা জটিলতর হয়ে ওঠে।
সুরক্ষায় করণীয়
• খেয়াল রাখবেন, কোনোভাবেই যেন কানে পানি না ঢোকে। অযথা কানে খোঁচাখুঁচি করা বা কটন বাডস ব্যবহারের অভ্যাস পরিহার করুন।
• কানে ব্যথা হলে গরম সেঁক নিতে পারেন।
• দীর্ঘক্ষণ কানে মোবাইল নিয়ে কথা বলবেন না। সামঞ্জস্যহীন হেডফোন বা ইয়ারফোন ব্যবহারে সচেতন হোন।
• কান বন্ধ হলে সাময়িক সমাধান হিসেবে চুইংগাম চিবুতে পারেন।
• সমস্যা বেশি হলে বা দীর্ঘমেয়াদি হলে নাক কান গলা রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
অধ্যাপক মেজর (অব.) ডা. এম মোতাহার হোসেন
এমবিবিএস, ডিএলও (ডিইউ), এফআইসিএস (ইউএসএ)
নাক-কান-গলা ও মাথা রোগ বিশেষজ্ঞ এবং সার্জন
ইএনটি, মাইক্রোসার্জারি ও এফইএসএসের ওপর অভিজ্ঞতা
চিফ কনসালট্যান্ট, নাক-কান-গলা বিভাগ
ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল, ঢাকা
খুভই উপকারী লেখা
অসংখ্য ধন্যবাদ “সুখেঅসুখে”