হরমোন সমস্যা : বিলম্বিত বয়ঃসন্ধি

হরমোন সমস্যা : বিলম্বিত বয়ঃসন্ধি

ডা. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম (সোহান)

বয়ঃসন্ধিকাল জীবনের এমন একটি পর্যায় যখন একজন ছেলে বা মেয়ে শিশুকাল থেকে কৈশোরকালে পদার্পণ করে। সাধারণত মেয়েদের ৮-১৩ বছর বয়সের মধ্যে বয়ঃসন্ধিকাল শুরু হয়। এ সময় একজন মেয়ের শরীরে প্রজনন হরমোন তৈরি হয়, পিরিয়ড শুরু হয় এবং স্তনের আকার পরিবর্তন হয়। অবশ্য শারীরিক অবস্থার তারতম্যের কারণে কিছুদিন আগে বা পরে কোনো মেয়ের বয়ঃসন্ধি শুরু হতে পারে, যা স্বাভাবিক। কিন্তু কারও যদি ১৩ বছর বয়সের পরও শারীরিক বিকাশ না ঘটে এবং ১৬ বছর বয়সেও পিরিয়ড শুরু না হয়, তাহলে বুঝতে হবে তার বয়ঃসন্ধি বিলম্বিত হচ্ছে। এ কারণে তার উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে কম হয়, হাড় বয়সের তুলনায় তেমন মজবুত হয় না এবং জরায়ু বিকশিত হয় না। ফলে মেয়েটিকে শারীরিক, মানসিক এমনকি সামাজিক নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। বিলম্বিত বয়ঃসন্ধির লক্ষণ প্রকাশ পেলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি।

বিলম্বিত বয়ঃসন্ধির কারণ

দেরিতে বয়ঃসন্ধি শুরু হওয়ার বেশ কিছু কারণ রয়েছে। যেমন—

  • কোনো পিতা-মাতার দেরিতে বয়ঃসন্ধি হলে তাঁদের সন্তানেরও বয়ঃসন্ধি বিলম্বিত হতে পারে।
  • দীর্ঘমেয়াদি কোনো রোগ যেমন— ডায়াবেটিস, কিডনি রোগ, হাঁপানি, এবং অন্যান্য জন্মগত রোগ থাকলে বয়ঃসন্ধি বিলম্বিত হয়।
  • টার্নার সিনড্রোমের মতো জিনগত রোগের কারণে বয়ঃসন্ধি ধীরে হয়।
  • পিটুইটারি গ্রন্থিতে টিউমার বা হাইপোপিটুইটারিজম থাকলে পর্যাপ্ত ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোন নিঃসৃত হয় না। ফলে বয়ঃসন্ধি বিলম্বিত হয়।
  • থাইরয়েড হরমোনের ভারসাম্যহীনতার কারণে বিলম্বিত বয়ঃসন্ধি হতে পারে।
  • দেহে সেক্স ক্রমোজোমের অস্বাভাবিকতার কারণে বয়ঃসন্ধি বিলম্বিত হয়।
  • পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবারের অভাব দেরিতে বয়ঃসন্ধি হওয়ার অন্যতম কারণ।
  • অতিরিক্ত ব্যায়াম বা একদমই ব্যায়াম না করলে সঠিক সময়ে বয়ঃসন্ধি না-ও হতে পারে।
  • অতিরিক্ত ওজন বা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম ওজনের কারণে বয়ঃসন্ধি দেরিতে হতে পারে।
  • অনেক সময় ক্যানসারের চিকিৎসা হিসেবে কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপি দিলে ডিম্বাশয়ের ক্ষতি হয়। ফলে বয়ঃসন্ধি বিলম্বিত হয়।

বিলম্বিত বয়ঃসন্ধির প্রভাব

বয়ঃসন্ধি বিলম্বিত হলে এর প্রভাব পড়ে শরীর ও মনে। বিলম্বিত বয়ঃসন্ধির কারণে একটি মেয়ের হাড় ক্ষয় রোগ হতে পারে। হ্রাস পেতে পারে তার সন্তান ধারণক্ষমতা। তা ছাড়া মেয়েটি যখন দেখে যে, তার বন্ধুরা তার তুলনায় দিন দিন বেড়ে উঠছে, তখন সে কষ্ট পায় ও মানসিক বিষণ্নতায় ভোগে। অনেক সময় সমাজে এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও তাকে হেয়প্রতিপন্ন হতে হয়। ফলে সে সবার থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখে এবং একাকিত্বে ভোগে। এ ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের উচিত হবে তাকে আশ্বস্ত করা এবং উত্সাহ দেওয়া। তাকে বোঝাতে হবে যে, সুচিকিৎসা ও সঠিক পদক্ষেপের মাধ্যমে বিলম্বিত বয়ঃসন্ধির সমস্যা সমাধান করা সম্ভব।

রোগনির্ণয় ও চিকিৎসা

কোনো মেয়ের বয়ঃসন্ধি কেন দেরিতে হচ্ছে, সে সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে তারপর চিকিৎসাব্যবস্থা নেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে কিছু শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা যেমন— এক্স-রে ও রক্তে হরমোনের মাত্রা পরীক্ষা করা জরুরি। পাশাপাশি গোনাডোট্রপিন ও সেক্স হরমোনের সঙ্গে জরায়ু ও ডিম্বাশয়ের আলট্রাসনোগ্রাম করার প্রয়োজন হতে পারে। এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে মেয়েটির শারীরিক বৃদ্ধির হার, হাড়ের গঠন ও বয়স এবং হরমোনের মাত্রা দেখে চিকিৎসাব্যবস্থা নেওয়া হয়। হরমোনজনিত সমস্যার কারণে বয়ঃসন্ধি বিলম্বিত হলে ইস্ট্রোজেন হরমোন থেরাপি দেওয়া হয়। এটি ১০-১১ বছর বয়সের মধ্যে দিলে ভালো হয়। ৩ মাসের জন্য সাময়িক এ থেরাপি দিলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সফলতা পাওয়া যায়। এ ছাড়া শরীরে জন্মগত বা দীর্ঘমেয়াদি কোনো রোগ কিংবা মানসিক সমস্যা থাকলে দ্রুত প্রয়োজনীয় চিকিৎসাব্যবস্থা নিতে হবে। অপুষ্টি ও শরীরে নির্দিষ্ট কোনো ভিটামিনের অভাব থাকলে তা পূরণ করতে হবে। পাশাপাশি পর্যাপ্ত ঘুম, সুষম ও স্বাস্থ্যকর খাবার এবং কাজকর্মে সক্রিয় থাকা জরুরি। আর যদি পরীক্ষা-নিরীক্ষায় শারীরিক কোনো সমস্যা ধরা না পড়ে তাহলে বুঝতে হবে জিনগত কারণে বয়ঃসন্ধি দেরিতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আতঙ্কিত না হয়ে অপেক্ষা করুন। কিছুদিন পর আপনাআপনিই বয়ঃসন্ধি শুরু হবে।



ডা. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম (সোহান)

ডা. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম (সোহান)

এমবিবিএস, ডিইএম, এমডি (এন্ডোক্রাইনোলজি, বারডেম)
ডায়াবেটিস, থাইরয়েড ও হরমোন বিশেষজ্ঞ
কনসালট্যান্ট, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ,
ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

LinkedIn
Share
WhatsApp