হাড় ও হাড়জোড়ায় ব্যথা কেন হয়
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রহমান সাহেব প্রতিদিন সকাল-বিকাল পার্কে হাঁটতে যান। পার্কে চার-পাঁচ জনের সঙ্গে বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কও তৈরি হয়েছে। হাঁটার পাশাপাশি এই আড্ডাটা দারুণ উপভোগ করেন তিনি। অবসরের পর ঝিমিয়ে থাকা জীবনে সকালের এইটুকু আড্ডা যেন তাঁর সারাদিনের রসদ জোগায়।
কিন্তু মাঝে মাঝে এই সুখটুকু তাকে বিসর্জন দিতে হয় হাঁটুর ব্যথার কারণে। আজকাল থেকে থেকেই হাঁটুর সন্ধিতে ব্যথা দেখা দেয়। প্রথম ক’দিন তেমন গুরুত্ব দেননি। তবে ইদানীং ব্যথাটা ভোগাচ্ছে খুব। হাড়ের জোড়ায় তীব্র ব্যথার পাশাপাশি ব্যথার স্থান ফুলে গেছে। ঠিকমতো হাঁটাচলা করতে অসুবিধা হচ্ছে। এমনকি ব্যথার কারণে তার ঘুমের ব্যঘাত ঘটছে। এই অবস্থায় দ্রুত চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করেন তিনি। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে জানতে পারেন তার হাড়ের ঘনত্ব কমে গেছে, হাড়ক্ষয় বেড়েছে।
হাড়ব্যথা কি রোগ? কেন হয় হাড়ব্যথা?
হাড়ব্যথা কোনো রোগ নয়, নানা রোগের উপসর্গ হিসেবে এটি দেখা দেয়। হাড়ের বেশিরভাগ ব্যথা হয় হাড়ের বাইরের স্নায়ু সংবেদনশীল আবরণ পেরিওসেটিয়াম আক্রান্ত হওয়ার ফলে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হাড়ের দুর্বল গঠন বা অস্টিওম্যালেসিয়ার কারণেও ব্যথা হতে পারে। আবার হাড় অকেজো হওয়া, যাকে অস্টিওপোরোসিস বলা হয়—এর কারণেও হাড়ের ব্যথা হতে পারে।
তা ছাড়া মানুষের বয়স বাড়লে হাড়েরও তো বয়স বাড়ে। অস্থিসন্ধি বা হাড়ের জোড়ার পরিবর্তন হয়। কোথাও কোথাও হাড়ের আকৃতিরও পরিবর্তন হয়। এ সময় হাড় ও হাড়জোড়ায় ব্যথাসহ নানা রকম রোগবালাই দেখা দেয়। সাধারণত চল্লিশোর্ধ মহিলা ও পঞ্চাশোর্ধ পুরুষ বার্ধক্যজনিত কারণে হাড়জোড়ার ব্যথায় ভুগে থাকেন। তবে যেকোনো বয়সের মানুষেরই এই সমস্যা দেখা দিতে পারে।
যেসব কারণে হাড় ও হাড়ের জোড়ায় ব্যথা হতে পারে—
- উচ্চতার তুলনায় দেহের ওজন অতিরিক্ত বেড়ে গেলে
- ডায়াবেটিস, হাইপোথাইরয়ে- ডিজমের সমস্যা থাকলে
- অস্টিওপোরোসিস, রিউমাটয়েড ও অস্টিওআর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত হলে
- ক্যালসিয়াম ও অন্যান্য অপুষ্টিজনিত সমস্যা থাকলে
- শরীরে ইউরিক অ্যাসিডের পরিমাণ বেড়ে গেলে
- অল্প বয়সে গেঁটে বাতের সমস্যা হয়ে থাকলে
- হাড়ের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি হলে
- হাড়ে আঘাত পেলে
- বংশগত কারণে
হাড়ব্যথার নানা ধরন
কোনো অসুখ বা দুর্ঘটনার কারণে হাড় ক্ষতিগ্রস্ত হলে শরীরের বিভিন্ন স্থানে ব্যথা হতে পারে। অস্থিসন্ধির বিভিন্ন ধরনের ব্যথার মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত ব্যথাগুলো নিম্নরূপ—
- হাঁটুর অস্থিসন্ধির ব্যথা
- কাঁধব্যথা
- কোমরব্যথা
- পায়ে ব্যথা
হাড় ও হাড়ের জোড়ায় ব্যথার উপসর্গ
সাধারণত বয়স বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক পরিশ্রম কমে আসে। এ সময় মাংসপেশির আকার ও হাড়ের ঘনত্বও কমে আসে। ফলে হাড়ের রোগবালাই বেড়ে যায়। হাড়ের জোড়ায় ব্যথা ও ব্যথার স্থান ফুলে যেতে পারে। আক্রান্ত স্থানের তাপমাত্রা বেড়ে যেতে পারে। অস্থিসন্ধি ভাঁজ করতে অসুবিধা বা ভাঁজ করার সময় শব্দ হতে পারে। এছাড়া আরো যেসব উপসর্গ দেখা দিতে পারে—
- আক্রান্ত স্থান লাল হয়ে ফুলে যেতে পারে
- নড়াচড়া করতে ব্যথা বা অস্বস্তি হতে পারে
- মাংসপেশি ও টিস্যুতে ব্যথা হতে পারে
- ব্যথার কারণে ঘুমের অসুবিধা হতে পারে
- আক্রান্ত স্থানের আকৃতির পরিবর্তন হতে পারে
- অতিরিক্ত ক্লান্তি ও দুর্বলতা দেখা দিতে পারে
- বুক, মাথা ও পিঠে ব্যথা হতে পারে
- দ্রুত ওজন কমে যেতে পারে
- হাড় ভেঙে যেতে পারে
- ক্ষুধামান্দ্য দেখা দিতে পারে
হাড় ব্যথার কারণ নির্ণয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা
বিভিন্ন কারণে হাড় ও হাড়ের জোড়ায় ব্যথা হয়ে থাকে। কী কারণে ব্যথা হচ্ছে প্রথমে সেই কারণটা জানা জরুরি। আঘাত ও বাতের কারণে যেকোনো বয়সেই অস্থিসন্ধি বা হাড়ের জোড়ায় ব্যথা হতে পারে। বয়স্কদের ক্ষেত্রে হাড়ের পরিবর্তনজনিত ব্যথা বেশি হতে দেখা যায়। ব্যথাসংক্রান্ত যেকোনো লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ামাত্র বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে।
এ ধরনের সমস্যার ক্ষেত্রে সাধারণত রোগীর রক্ত, ইউরিক অ্যাসিড, ডায়াবেটিস প্রভৃতি পরীক্ষা করা হয়। এছাড়া এমআরআই, সিটিস্ক্যান, ক্যানসার নিশ্চিতকরণে ক্যানসার মার্কার, হাড়ের এক্স-রে প্রভৃতি পরীক্ষা করার প্রয়োজন হতে পারে।
চিকিৎসা ও প্রতিরোধ
একটু বয়স বাড়লেই হাড় ও জোড়ার ব্যথা দেখা দিতে থাকে। তা ছাড়া কাজ বা খেলাধুলা করতে গিয়ে যে কেউ আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারেন। আবার জটিল কোনো রোগের উপসর্গ হিসেবেও হাড়ে ব্যথা হতে পারে। তাই হাড়ের ব্যথা নিয়ে বসে থাকা ঠিক নয়। শুরুতেই ব্যথার চিকিৎসা করলে বড়ো ধরনের বিপদ এড়ানো যায়। হাড়ের ব্যথার কারণ নির্ণয় করে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে হবে। হাড় ও হাড়জোড়ার ব্যথা প্রতিরোধে সচেতনতা ও সাবধানতা বিশেষভাবে জরুরি।
- উচ্চতা অনুযায়ী দেহের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন।অতিরিক্ত ওজন কমান।
- নিয়মিত খাদ্যতালিকায় তাজা ফল ও শাকসবজি রাখুন।
- নিয়মিত ভিটামিন-সি, ই, ডি ও ক্যালসিয়ামযুক্ত খাবার খান।
- পেশি সচল রাখতে নিয়মিত শরীরচর্চা করুন।
- চেয়ারে বসলে মেরুদণ্ড সোজা রেখে বসুন।
- ব্যথা বেশি হলে হাই কমোড ব্যবহার করুন।
- উঁচু হিলের জুতা পরার অভ্যাস থাকলে ত্যাগ করুন।
- ব্যথা কমে গেলে নিয়মিত হাঁটুন। শরীর সচল রাখুন।
- বিশেষজ্ঞের নির্দেশনামতো শরীরচর্চা করুন। ব্যথা বাড়লে বন্ধ রাখুন।
- ব্যথা উপশমে নিজে নিজেই ব্যথার ওষুধ সেবন করবেন না।
- আক্রান্ত স্থান পর্যাপ্ত বিশ্রামে রাখুন।
- অতিরিক্ত নরম বিছানায় ঘুমাবেন না।
- ব্যথার স্থানে কোনো ধরনের মালিশ করবেন না।
- অ্যান্টিবায়োটিক দিলে পুরো কোর্স সম্পন্ন করুন।
- নিয়মিত সাঁতার কাটুন
অধ্যাপক ডা. সমীরণ কুমার সাহা
এমবিবিএস, পিএইচডি (মেডিসিন)
এফএসিপি, এফআরসিপি (এডিন)
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ
অনারারি প্রফেসর, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
সিনিয়র কনসালট্যান্ট, মেডিসিন বিভাগ
ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল