হৃদ্রোগীদের খাদ্যাভ্যাস : কী খাবেন, কী খাবেন না
ফাহমিদা হাসেম
হৃদ্রোগে যাঁরা আক্রান্ত হয়েছেন বা যাঁদের হৃদ্রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে, তাঁদের অবশ্যই সুনির্দিষ্ট খাদ্যাভ্যাস মেনে চলা উচিত। নিয়ন্ত্রিত ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস হৃদ্রোগের ঝুঁকি কমিয়ে হৃৎপিণ্ডকে রাখে সুস্থ ও কর্মক্ষম। কিছু খাবার আছে, যা হৃদ্রোগের অন্যতম কারণ। আবার, কিছু খাবার আছে যা হৃদ্যন্ত্রকে সুস্থ রাখতে অত্যাবশ্যক। দৈনন্দিন খাদ্যতালিকা থেকে হৃদ্রোগের ঝুঁকি বাড়ায়, এমন খাবার বাদ দিয়ে স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর খাবার রাখতে হবে, যা হৃৎপিণ্ডকে সচল ও স্বাভাবিক রাখতে সক্ষম।
যেসব খাবার বাদ দিতে হবে
ট্রান্সফ্যাটসমৃদ্ধ খাবার : সব ধরনের প্রক্রিয়াজাত খাবার ও স্ন্যাকস (মাইক্রোওয়েভ পপকর্ন, ইন্সট্যান্ট নুডলস, স্যুপ ও সিরিয়াল, চিপস, চিনি দেওয়া তরল পানীয়), তেলে ভাজা খাবার, ময়দা ও চিনি দিয়ে তৈরি সব বেকারি আইটেম (বিস্কুট, কেক, পেস্ট্রি) রক্তের খারাপ চর্বি এলডিএলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় ও ভালো চর্বি এইচডিএলের পরিমাণ কমায়। ফলে, হৃদ্রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

স্যাচুরেটেড ফ্যাটযুক্ত খাবার : প্রক্রিয়াজাত মাংস (সসেজ), হাড়ের মজ্জা, চর্বিযুক্ত লাল মাংস, ননিযুক্ত দুধ ও দুধের তৈরি খাবার, তেলে ভাজা খাবার, ঘি, মাখন, ডালডা, আইসক্রিম রক্তের খারাপ কোলেস্টেরল বাড়িয়ে হৃৎপিণ্ডের ধমনিতে প্লাক/ক্লট তৈরি করে, যা পরবর্তী সময়ে হৃদ্রোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়।
অতিরিক্ত সোডিয়ামযুক্ত খাবার : প্যাকেট ও ক্যানের খাবার, চিপস, চানাচুর, আচার, শুঁটকি, সস, পনির, ইন্সট্যান্ট নুডলস, বেকিং পাউডার, বেকিং সোডা, টেস্টিং সল্ট, মগজ ও ফাস্ট ফুড উচ্চ রক্তচাপ তৈরি করে। এতে হৃদ্রোগের আশঙ্কা বেড়ে যায়। এ ছাড়া অতিরিক্ত লবণ হৃৎকোষে পানির পরিমাণ বাড়িয়ে হৃৎপিণ্ডের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। ফলে, হৃৎপিণ্ডের স্বাভাবিক কাজ বাধাগ্রস্ত হয়।
তরল চিনি : পরিশোধিত চিনিকে বলা হয় হোয়াইট পয়জন বা সাদা বিষ। বাণিজ্যিকভাবে কোল্ড ড্রিংকস, চিনি দেওয়া চা-কফি, ইন্সট্যান্ট সিরিয়াল ডায়াবেটিস ও ওজন বাড়ায়, যা হৃদ্রোগের অন্যতম কারণ। অতিরিক্ত চিনি দেহে সংক্রমণ তৈরি করে হৃৎপিণ্ডের কাজে বাধা দেয়।
রিফাইন্ড কার্বোহাইড্রেট : সাদা চাল, সাদা আটার রুটি, সাদা ময়দার তৈরি সব খাবার রক্তে শর্করার মাত্রা অনেক বাড়িয়ে দেয়, যা ইনসুলিনের কাজে বাধা দেয়। ফলে, হৃদ্রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
যেসব খাবার খেতে হবে
সামুদ্রিক মাছ : স্যামন, টুনা, ইলিশ। এসব সামুদ্রিক মাছে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড আছে, যা হৃদ্রোগের আশঙ্কা কমিয়ে হৃৎপিণ্ডকে সুস্থ রাখে।
শস্যজাতীয় খাবার : লাল আটার রুটি, লাল চালের ভাত, ওটস, চিড়া, কুইনোয়া, ভুট্টা, বার্লি, মাল্টিগ্রেইন সিরিয়াল ইত্যাদি কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেটের ভালো উৎস। এসব খাবারে প্রচুর আঁশ থাকে, যা রক্তের খারাপ কোলেস্টেরল কমাতে ও ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে। এ ধরনের কার্বোহাইড্রেট ক্যালরি ও ওজন নিয়ন্ত্রণ করে হৃৎপিণ্ডকে সুস্থ রাখে।
গাঢ় সবুজ শাকসবজি : ছোটবেলা থেকে যারা নিয়মিত শাকসবজি খায়, তাদের হৃদ্রোগের ঝুঁকি অনেক কম থাকে। শাকসবজির পটাশিয়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে, যা হৃৎপিণ্ডের কাজের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। শাকসবজির মিনারেল, ভিটামিন ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট কোষের ফ্রি-রেডিক্যাল ধ্বংস করে হৃদ্রোগের ঝুঁকি কমায়। রোজ ২-৩ রকমের সবজি খেলে হৃৎপিণ্ড সুস্থ থাকে।
ডিম : হৃদ্রোগ নিয়ন্ত্রণে ডিম বিতর্কিত একটি বিষয়। অনেকেই ভাবেন, হৃৎপিণ্ডের অসুস্থতা মানে ডিম খাওয়া যাবে না। এটি ভুল ধারণা। ১টি ডিমের কুসুমে ২০০ মিলিগ্রাম কোলেস্টেরল থাকে, যা প্রতিদিন দেহে ব্যবহার হয়ে যায়। তাই অন্যান্য অস্বাস্থ্যকর ফ্যাট কমিয়ে রোগের ধাপ অনুযায়ী সপ্তাহে দুই দিন ডিমের কুসুম ও বাকি দিন সাদা অংশ খাওয়া যেতে পারে। তবে, সেটা অবশ্যই স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী।
বাদাম ও সিডস : কাঠবাদাম, আখরোট, চিয়া সিড, ফ্ল্যাক্স সিডস ভিটামিন-ই ও ওমেগা-৩ -এর ভালো উৎস। ১ টেবিল চামচ ফ্ল্যাক্স সিডসে ২.৩ গ্রাম আলফা-লিনোলেইক অ্যাসিড থাকে। ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড খারাপ চর্বি ট্রাইগ্লিসারাইডের পরিমাণ কমিয়ে হৃৎপিণ্ডকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। হৃদ্রোগীরা মধ্যকালীন নাশতায় অবশ্যই বাদাম রাখবেন, তবে কাজুবাদামে ফ্যাট বেশি থাকায় কম খাওয়া ভালো।
লাইকোপিন : টমেটো, পাকা পেঁপে, গোলাপি দেশি পেয়ারা, জাম্বুরা, ডালিম, মিষ্টি কুমড়া, বেগুনি বাঁধাকপি, লাল ক্যাপসিকামে শক্তিশালী অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট লাইকোপিন থাকে, যা হৃৎপিণ্ডকে সুস্থ রাখতে সহায়ক।
বেরিজাতীয় ফল : স্ট্রবেরি, ব্লুবেরি, ব্ল্যাকবেরি— এ জাতীয় ফল ফ্লেভোনয়েড ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্টসমৃদ্ধ হওয়ায় তা হৃৎকোষকে কর্মক্ষম রাখতে সাহায্য করে।
সীমিত তেল : হৃৎপিণ্ডকে সুস্থ রাখতে চাইলে রান্নায় তেলের ব্যবহার সীমিত রাখতে হবে। সারাদিনে রান্নায় সর্বোচ্চ ২ টেবিল চামচ তেল ব্যবহার করুন। অলিভ অয়েল, অ্যাভোকাডো অয়েল, তিলের তেল, তিশির তেল, ক্যানোলা তেল, রাইস ব্র্যান তেল মোটামুটি হৃদ্বান্ধব।
তবে শুধু খাদ্যাভ্যাস নয়; ওজন ঠিক রেখে নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করুন, হৃদ্রোগের ঝুঁকিমুক্ত থাকুন।

ফাহমিদা হাসেম
সিনিয়র পুষ্টিবিদ
ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল