হৃৎপিণ্ডের যত্নে করণীয়

হৃৎপিণ্ডের যত্নে করণীয়

অধ্যাপক ডা. আবদুজ জাহের

হৃৎপিণ্ড মানুষের শরীরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। হৃৎপিণ্ডের মাধ্যমে সারা দেহে রক্ত সঞ্চালিত হয়। শরীর সুস্থ রাখতে হলে হৃদ্ যন্ত্র সুস্থ রাখা জরুরি। কিন্তু আমরা প্রতিদিন এমন কিছু কাজ করি, যার জন্য হৃৎপিণ্ডের ক্ষতি হয়। হয়তো সঙ্গে সঙ্গে সেটা প্রকাশ পায় না। কিন্তু দীর্ঘদিনের অসচেতনতা ও অযত্নে জটিল কিছু হৃদ্‌রোগের সৃষ্টি হয়। এর জন্য মৃত্যুও হতে পারে। একটু সচেতনতা ও দৈনন্দিন জীবনে কিছু অভ্যাস গড়ে তুলতে পারলে হৃৎপিণ্ড থাকবে সুস্থ-সবল।

কীভাবে নেব হৃৎপিণ্ডের যত্ন

হৃৎপিণ্ড সুস্থ থাকলে শরীর সুস্থ থাকবে, কর্মক্ষম থাকবে। তাই হৃৎপিণ্ডের যত্নে অবহেলা করা যাবে না। পরিমিত খাবার, নিয়মিত ব্যায়াম, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখাসহ প্রতিদিনের জীবনযাপনে কিছু বিষয় মেনে চললে হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি কমে যাবে।

প্রতিদিন ব্যায়াম করুন

হৃৎপিণ্ড ভালো রাখতে প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট ব্যায়াম করুন। ৩০ মিনিট ব্যায়াম যে একটানা করতে হবে, এমন নয়। সময়টাকে ভেঙে নিতে পারেন। সকালে ১০ মিনিট ব্যায়াম করলেন, বিকেলে ১০ মিনিট আবার রাতে ঘুমানোর আগে ১০ মিনিট। একটু হাঁটা, বাগান করা, সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করা বা যেকোনো কাজের মধ্য দিয়েও ব্যায়াম সেরে নিতে পারেন। নিয়মিত ব্যায়াম করলে শরীরের রক্ত চলাচল স্বাভাবিক থাকে। রক্ত চলাচল স্বাভাবিক থাকা মানেই হৃৎপিণ্ড সুস্থ থাকা।

ধূমপান ও মদপানকে ‘না’ বলুন

ধূমপান একটি মারাত্মক বদ অভ্যাস। ধূমপান, মদপান ও যেকোনো তামাকজাতীয় দ্রব্য শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি করে, উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি করে ও হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়। সিগারেটের মধ্যে যে নিকোটিন থাকে, তা হার্টের জন্য খুবই ক্ষতিকারক। ধূমপানের কারণে হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়, ধমনিতে রক্ত জমাট বেঁধে যায়। এর ফলে হার্ট অ্যাটাক হয়। ধূমপায়ী ব্যক্তি যখন ধূমপান করে তখন তার আশপাশে যারা থাকে তারাও সমান ক্ষতির শিকার হয়। তাই ধূমপান ও মদপান পুরোপুরি এড়িয়ে চলুন। এর ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে ভাবুন। নিজেকে ব্যস্ত রাখুন। এতে ধূমপানের ইচ্ছা কমে যাবে, হার্ট সুস্থ থাকবে।
গুরুত্ব দিন পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাসের ব্যাপারে হৃৎপিণ্ড সুস্থ রাখতে পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। প্রচুর পরিমাণে আঁশ আছে, এমন খাবার খান। শিম, মটরশুঁটিজাতীয় সবজি, ডালজাতীয় শস্য এবং ফলমূলে প্রচুর আঁশ থাকে। খাদ্যতালিকায় এসব খাবার রাখুন। এই খাদ্যগুলো রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ বেশি আছে এমন খাবার খান। এসব খাবার শরীর ও হার্ট সুস্থ রাখে। চর্বিজাতীয় খাদ্য যেমন— চিজ, দই, লাল মাংস, মাখন, কেক, নারকেল তেল এগুলো কম খাওয়ার চেষ্টা করুন। এসব খাবারে জমাট বাঁধা চর্বি থাকে, যা কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে বেড়ে যায় হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি। লবণ বেশি খেলে রক্তচাপ বেড়ে যায়, যা হার্টের জন্য ক্ষতিকর। তাই লবণ খাওয়া কমিয়ে দিন। ফাস্ট ফুড ও প্যাকেটজাত খাবার এড়িয়ে চলুন।

ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন

অতিরিক্ত ওজনের কারণে শরীরে নানা রকম রোগ হয়। শরীরের অতিরিক্ত চর্বি রক্তে কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে রক্তনালির দেয়ালে চর্বি জমতে থাকে। এতে বেড়ে যায় হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি। যাঁদের ওজন বেশি, তাঁদের ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা বেশি। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের হৃদ্‌রোগ বেশি হয়। তাই হৃদ্ যন্ত্র সুস্থ রাখতে শরীরের উচ্চতা অনুযায়ী ওজন স্বাভাবিক রাখুন। কম ক্যালরিযুক্ত খাবার খান। চিনি ও মিষ্টিজাতীয় খাবার এড়িয়ে চলুন। ওজন কমাতে প্রতিদিন কিছু সময় হাঁটাহাঁটি, সাঁতার কাটা, সাইকেল চালানো ও জগিং করার অভ্যাস করতে পারেন। তবে ৫০ বছর বয়সের পর জগিং করা ঠিক হবে না, ব্যায়াম করাই যথেষ্ট। যেকোনো বয়সে হাঁটার অভ্যাস করুন।

প্রতিদিন ৬-৯ ঘণ্টা ঘুমান

ঘুম কম হলে শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যায়। পর্যাপ্ত ঘুম না হলে হৃদ্ যন্ত্রের ধমনিতে ক্যালসিয়াম জমতে থাকে, ফলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। যাঁরা কম ঘুমান, তাঁদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের হার বেশি। উচ্চ রক্তচাপ হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। ডায়াবেটিস হৃদ্ যন্ত্রসহ শরীরের অন্যান্য রক্তনালির ক্ষতি করে। তাই হার্ট সুস্থ রাখতে প্রতিদিন ৬-৯ ঘণ্টা ঘুমান।

মানসিক চাপ কমান

কর্মক্ষেত্র, সমাজ, পরিবার কিংবা ব্যক্তিগত কারণে মানুষ বিভিন্ন রকম মানসিক চাপে থাকে। মানসিক দুশ্চিন্তা বা হতাশা উচ্চ রক্তচাপের অন্যতম কারণ। এর ফলে হতে পারে হৃদ্ যন্ত্রের বিভিন্ন রোগ। তাই হৃৎপিণ্ড ভালো রাখতে মানসিক চাপ কমানো জরুরি। অনেকে মানসিক হতাশা থেকে মুক্তি পেতে ধূমপান, মদপান বা বিভিন্ন নেশাজাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করা শুরু করে। এগুলো হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি আরও কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়। ইতিবাচক কাজের মাধ্যমে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করুন। পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন। নিজেকে সময় দিন। নিজের পছন্দের কাজগুলো করুন। মানসিক চাপ কমাতে যোগব্যায়াম করতে পারেন।

নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করুন

একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর শরীরের ওজন, রক্তচাপ, কোলেস্টেরলের মাত্রা ও ডায়াবেটিস পরীক্ষা করুন। এর মধ্যে কোনো একটা যদি স্বাভাবিকের চেয়ে কম বা বেশি হয়, তাহলে সচেতন হোন। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করুন।


অধ্যাপক ডা. আবদুজ জাহের

এমবিবিএস, এফসিপিএস (মেডিসিন),
এফএসিসি (ইউএসএ), এফআরসিপি
অধ্যাপক, কার্ডিওলজি
ক্লিনিক্যাল ও ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট
প্রাক্তন অধ্যাপক,
জাতীয় হৃদ্‌রোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল
সিনিয়র কনসালট্যান্ট, ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

LinkedIn
Share
WhatsApp