শিশু কি জন্মগত হৃদ্রোগে ভুগছে
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল প্রফেসর নুরুন্নাহার ফাতেমা
আদনানের বয়স তখন মাত্র সাত দিন। ছোট ছোট হাত-পা নেড়ে সে নিজের মতো করে খেলে। ঘুমের মধ্যেই মুখে হাসি ফুটে ওঠে। রাত জেগে বাবা-মা আদনানের সেই হাসিমাখা মুখের দিকে চেয়ে থাকে। হাসপাতাল থেকে ছুটি নিয়ে আদনান মায়ের কোলে করে বাড়িতে ফিরল। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আদনানের শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। আস্তে আস্তে সে নীল হয়ে যেতে থাকল। হাসিমাখা সে মুখ মুহূর্তে মলিন হয়ে গেল। বাবা-মা আদনানকে নিয়ে দ্রুত ছুটে গেলেন একটি বিশেষায়িত হাসপাতালে। ধরা পড়ল সিভিয়ার কোয়ার্কটেশন অব অ্যাওর্টা নামের জটিল এক হৃদ্রোগ। পরদিনই তাকে কার্ডিয়াক ক্যাথেটারাইজেশন করা হলো এবং ব্যালুনের মাধ্যমে চিকন রক্তনালি বড় করে দেওয়া হলো। বাচ্চাটির জীবন রক্ষা পেল। পুরো পরিবারে আবার ফিরে এলো হাসি।
জন্মগত হৃদ্রোগের কারণ কী
জন্মগত হৃদ্রোগের সঠিক কারণ এখনো খুঁজে বের করার জন্য বিশেষজ্ঞরা কাজ করছেন। যে সব কারণে জন্মগতভাবে হৃৎপিণ্ডে ত্রুটি থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয় সেগুলো হলো, মায়ের যদি গর্ভাবস্থায় কোনো মারাত্মক সংক্রমণ থাকে সে ক্ষেত্রে শিশুর ওপর সে প্রভাব পড়তে পারে। এ ছাড়া কিছু কনজেনিটাল রোগ, বংশগত রোগ, ডাউন সিনড্রোম, মারফেন সিনড্রোম বা টার্নার সিনড্রোম এগুলোর সঙ্গে হৃদ্রোগের ত্রুটিগুলো যুক্ত থাকতে পারে। কিছু ওষুধের প্রভাবে এবং ধূমপান বা মদ্যপানের অভ্যাস থাকলেও জন্মগত হৃদ্রোগের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে।
জন্মগত হৃদ্রোগের লক্ষণসমূহ
শিশুর ঘন ঘন শ্বাসকষ্ট হতে পারে। বুকের দুধ টেনে খেতে কখনো অসুবিধা হয়। সামান্য খেলাধুলায় শিশুটি হাঁপিয়ে যেতে পারে। হাত ও পায়ের আঙুলে, ঠোঁটে নীলাভ ভাব থাকতে পারে। এ ছাড়াও যে উপসর্গগুলো দেখা দিলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে—
- কান্নার সময় শিশুর মুখের রং কালচে হয়ে আসা।
- শিশুটির জন্মের পর ঘন ঘন শ্বাসকষ্ট।
- ঠোঁটে নীলাভ বা কালচে রং ধারণ।
- শিশুর হৃৎস্পন্দনে অস্বাভাবিকতা থাকা।
- মায়ের দুধ পান করার সময় শিশু যদি হাঁপিয়ে যায়।
- দুধ পান করার সময় শিশুটি যদি অস্বাভাবিক রকম ঘামে।
- শিশুটির ওজন স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক কম থাকা।
- খেলাধুলার সময় মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া।
এ ছাড়া শিশু অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো লক্ষণগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে।
জন্মগত হৃদ্রোগ নির্ণয়
শিশুর জন্মগত হৃদ্রোগ গর্ভাবস্থাতে কিংবা জন্মের পরপরই নির্ণয় করা যায়। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে শিশু বড় হওয়ার আগ পর্যন্ত বোঝা যায় না। সাধারণত ১৮ থেকে ২২ সপ্তাহের মধ্যে গর্ভস্থ শিশুর জন্মগত হৃৎপিণ্ডের ত্রুটি নির্ণয় করা যায়।
গর্ভাবস্থায় রোগ নির্ণয়
ফেটাল ইকো টেস্টের মাধ্যমে গর্ভাবস্থায় শিশুর হৃৎপিণ্ড পরীক্ষা করা যায়। এই টেস্টের মাধ্যমে শিশু গর্ভে থাকা অবস্থাতেই তার হার্টের ছবি তৈরি করা যায়। গর্ভাবস্থায় ১৮-২২ সপ্তাহের মধ্যে এই টেস্ট করা যায়। গর্ভকালীন সময়ে কোনো অস্বাভাবিকতা দেখা দিলে চিকিৎসক এই টেস্ট করার পরামর্শ দিতে পারেন। এই টেস্টের মাধ্যমে শিশুর হৃৎপিণ্ডে স্বাভাবিকতা সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়।
জন্মের পর রোগ নির্ণয়
হৃদ্রোগের লক্ষণ দেখা গেলে চিকিৎসক স্টেথেস্কোপের মাধ্যমে প্রথমেই শিশুর হার্ট ও ফুসফুস পরীক্ষা করে দেখবেন। চিকিৎসক ইকোকার্ডিওগ্রাম দিতে পারে। এর মাধ্যমে হার্টবিট, ভালভ ও হার্টের অন্যান্য অংশ পরীক্ষা করে দেখা যায়। এ ছাড়া ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রামের মাধ্যমে হৃৎস্পন্দনে কোনো অস্বাভাবিকতা আছে কি না পরীক্ষা করে দেখা হয়। চেস্ট এক্সরে, হলটার মনিটরিং, ক্যাথ স্টাডি, কার্ডিয়াক সিটিস্ক্যান, এমআরআই ইত্যাদিও করা যেতে পারে। এছাড়া কালার ডপলার মেশিনে এ ধরনের হৃদ্রোগ শনাক্ত করা যায়।
ঝুঁকি কমাতে করণীয়
- বেশিরভাগ জন্মগত হৃদ্রোগ প্রতিরোধ করা যায় না। তবে কিছু কিছু নিয়ম মেনে এর ঝুঁকি কমানো যায়।
- গর্ভধারণের তিন মাস পূর্বে মায়েদের রুবেলা ভাইরাসের ভ্যাকসিন প্রদান।
- গর্ভকালীন সময়ে মায়েদের বাচ্চার জন্য ক্ষতিকর ওষুধ সেবন থেকে বিরত থাকা।
- গর্ভাবস্থায় ডায়বেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা।
- রক্তের সম্পর্কে বিয়ে পরিহার করা।
- অধিক বয়সে গর্ভধারণ করা।
নবজাতকের হৃদ্রোগের চিকিৎসা
- কিছু নবজাতককে বাঁচানোর জন্য বিনা অপারেশনে চিকিৎসার প্রয়োজন হয়, যা বাংলাদেশ সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল ও ল্যাবএইড হাসপাতালের শিশু হৃদ্রোগ বিভাগে হয়ে থাকে।
- কিছু রোগীকে ওষুধের মাধ্যমে সম্পূর্ণভাবে সুস্থ করা যায়। তবে সঠিক চিকিৎসা না পেলে এদের ৪০-৫০% রোগী মৃত্যুবরণ করার শঙ্কা থাকে।
- কিছু রোগীকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। ওষুধে অনেক রোগী ভালো হয়ে যায়, আবার অনেক ক্ষেত্রে তাদের ডিভাইস ক্লোজার অথবা অপারেশন লাগে।
- কিছু জটিল রোগীকে ওষুধ দিয়ে আপাতঃ সুস্থ রাখা হয়। পরে তাদের অপারেশন করানো হয়।
- খুব অল্প সংখ্যক রোগী আছে, যারা হার্টের বিট সংক্রান্ত রোগ, মাংশপেশির দুর্বলতা ইত্যাদিতে ভোগে, যেটি সঠিক সময়ে নির্ণয় করতে পারলে সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব।
আদনান ছিলো ভাগ্যবান শিশু, তার মা-বাবা যথাসময়ে তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে আসেন। কিন্তু অনেক শিশু জন্মের ৭ দিনের মধ্যেই মারা যায়, যাদের রোগই ধরা পড়ে না। সম্প্রতি এক পরিসংখ্যানমতে, প্রতি হাজার জীবিত শিশুর মধ্যে ২৫ জনেরই জন্মগত হার্টের রোগ থাকতে পারে। এদের মধ্যে অনেক শিশুই জন্মের ১ মাসের মধ্যে মারা যায় এবং কিছু শিশু জন্মের ১ বছরের মধ্যে মারা যায়। কিন্তু যথাসময়ে সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় ও যথাযথ চিকিৎসা দিলে এসব শিশুকে বাঁচানো সম্ভব।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল প্রফেসর নুরুন্নাহার ফাতেমা
এমবিবিএস, এফসিপিএস (পেডিয়াট্রিকস), এফএসসিএআই
ফেলো ইন ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড ইন্টারভেনশনাল পেডিয়াট্রিক
কার্ডিওলজি অ্যান্ড ইন্টেনসিভ কেয়ার, পিএসিসি, কেএসএ
পেডিয়াট্রিক ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট
সিএমএইচ, ঢাকা
স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত
ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল